হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ

 

 : লড়াই হবে দ্বিমুখি

শাহনেওয়াজ খান সুমন: উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্রমেই অশান্ত হচ্ছে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা। বাউল সম্রাট লালন শাহ এবং তার গুরু সিরাজ সাঁইয়ের জন্মস্থান এ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন চতুর্থ দফায় আগামী ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৩ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর প্রচারণাকে কেন্দ্র করে এ উপজেলায় উভয় দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে নির্বাচন আচরণবিধিও। গত দু দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন।

একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮২৮। জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ ফেব্রয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে হলেও এ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে।  ফলে এখানে ভোটের মূল্যায়ন হবে বলেও জানান সাধারণ ভোটাররা।

নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী হরিণাকুণ্ডু উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক চাঁদপুর ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাড. এমএ মজিদ মোটরসাইকেল প্রতীক, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম আনারস প্রতীক ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী মাও. আকরাম হোসাইন দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন। সাধারণ ভোটাররা জানান, চেয়ারম্যান পদে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর দ্বিমুখি লড়াই হবে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. শহিদুল ইসলাম শিলু চশমা প্রতীক, জামায়াত সমর্থিত রেজাউল ইসলাম টিউবওয়েল প্রতীক, স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হাসান তালা প্রতীক ও মো. আমিরুজ্জামান চৌধুরী উড়োজাহাজ প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে লড়ছেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি প্রার্থী না দেয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম শিলুর সাথে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী রেজাউল ইসলামের সাথে লড়াই হবে বলে ভোটাররা জানান। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী পদে বিএনপি সমর্থিত সেলিনা খাতুন কলস প্রতীক, আওয়ামী লীগ সমর্থিত মাহমুদা আক্তার কেয়া ফুটবল প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোছা. নাছিমা আক্তার মায়া হাঁস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়াই হকে ত্রিমুখি।

এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল নেতাকর্মী ও ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ আমেজ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে উপজেলা বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে। যার ফলে তারা জোটগতভাবে দিয়েছেন একক প্রার্থী। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী এ দু দলের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোন্দল ভুলে কাজ করেছন নিজ দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচার-প্রচারণায় অংশ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন জামায়াত-বিএনপিসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী অ্যাড. এমএ মজিদ অভিযোগ করেছেন, তার নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা-মারধর, নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা, প্রচার মাইক ভাঙচুর এবং ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ২৫টি ভোটকেন্দ্র দখল করে ভোট কেটে তার বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল করিম মিন্টু ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। তার দু সমর্থককে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া ও ৩ সমর্থককে ব্যাপক মারপিট করা হয়েছে। মামলা না থাকা সত্ত্বেও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। বিএনপি সমর্থকরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব বিষয়ে জেলা রিটার্নিং অফিসারসহ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বারবার জানানোর পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে তিনি অভিযোগ করেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী রবিউল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেয়ায় ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে চরমপন্থি পরিচয়ে মোবাইলফোনে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। তাকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত থাকা ও এলাকায় না যেতে বলা হয়েছে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাড. এমএ মজিদ ও জেলা বিএনপির সভাপতি মসিউর রহমান তার কর্মী সমর্থকদের হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। তারা কালো টাকা ব্যবহার ও সন্ত্রাসীবাহিনী গঠন করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

ভোটের মাঠের লড়াই জমে উঠলেও অজানা আশঙ্কার মধ্যে ভোটাররা শঙ্কিত জীবনযাপন করছেন। ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি। পাড়া-মহল্লায়, হাট-বাজার ও সড়কের মোড়ের চা-স্টলগুলো নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ভোটাররা হিসাব মিলাতে পারছে না। সকলের একই প্রশ্ন কে হবেন হরিণাকুণ্ডুর চতুর্থ উপজেলা চেয়ারম্যান?

এ উপজেলার ৬২টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩১টি ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ। চাঁদপুর ইউনিয়নের মোকিমপুর, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের ভবিতপুর, পোড়াহাটি, তোলা, শ্রীফলতলা, গাড়াবাড়িয়া, ফলসি ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া, কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া, ঘোড়াগাছা, শিতলী, শাখারীদহ, দৌলতপুর ইউনিয়নের ফতেপুর, দখলপুর, কেবি একাডেমী, সোনাতনপুর, রিশখালী, গোবরাপাড়া, হিঙ্গেরপাড়া, তাহেরহুদা ইউনিযনের ভবানীপুর গ্রামের দুটি, নারায়নকান্দি, তাদেরহুদা, জোড়াদহ ইউনিয়নের ভেড়াখালী, লালন একাডেমী, ভায়না ইউনিয়নের তৈলটুপি, বাকচুয়া, দোবিলা, কালিশঙ্করপুর ও পৌর এলাকার শুড়া রেজি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চটকাবাড়িয়া এবং মান্দারতলা জোড়াপুকুরিয়া ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। তবে নির্বাচনে অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহকারী রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন।

সর্বশেষ ২০০৯ সালের নির্বাচনে এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জামায়াত নেতা মোতাহার হোসেন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। পুলিশ কনস্টেবল ওমর ফারুক হত্যা মামলায় বর্তমানে তিনি জেলহাজতে রয়েছেন।