কেরুজ চিনিকলের ৩ মাড়াই মরসুমের চিনি অবিক্রিত : কর্তৃপক্ষের কপালে ভাজ

 

চলতি মাড়াই মরসুমের নির্ধারিত দিবস অতিক্রম : মাড়াই চলবে আরো দু সপ্তাহ

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ড: দেশের বেসরকারি চিনি কারখানাগুলোর কারণেই সরকারি চিনি কারখানায় উৎপাদিত চিনি অবিক্রিত হয়ে পড়ে রয়েছে। সরকারের সাথে পাল্লা দিয়ে ২ টাকা কমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিনি বিক্রি করছে। সরকার চিনির মূল্য কেজিতে ১০ টাকা কমালেও হচ্ছে না বিক্রি। পরপর দুটি মরসুমে উৎপাদিত চিনি এখনো অবিক্রিত রয়েছে। সেই চিনিতেই নির্ধারিত গোডাউন কানায় কানায় ভরে আছে। কেরুজ চিনিকলসহ দেশের সবকটি চিনিকল অবিক্রিত চিনি নিয়ে মহাবিপাকে রয়েছে। চলতি মরসুমের উৎপাদিত চিনি রাখার গোডাউন সঙ্কুলান হওয়ায় বেছে নিতে হচ্ছে বিভিন্ন স্থান। কেরুজ চিনিকলের নির্ধারিত মাড়াই দিবস পেরিয়ে গেছে। আরো দু সপ্তা মিলে আখমাড়াই চলবে। আখ মাড়াইয়ের লক্ষমাত্রা পেরুনোর তুলনায় চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা খুব বেশি পেরুবে না। কেরুজ চিনিকলের ২০১২-১৩ আখমাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় সে বছরের ৭ ডিসেম্বর। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ১ হাজার ৭৪ একর এবং কৃষকদের জমিসহ সর্বমোট ৮ হাজার ৩শ একর জমির আখের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ের। সে বছর মাঠে আরো বেশি আখ থাকায় নির্ধারিত মাড়াই দিবস অতিক্রম করে অতিরিক্ত ১৬ দিন চলে মাড়াই কার্যক্রম। সে বছর আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে গেলেও চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পৌঁছুতে পারেনি মিল কর্তৃপক্ষ। ৫৬ দিবসের স্থলে ৭২ মাড়াই দিবসে আখমাড়াই করে ৭৯ হাজার ৪শ ৮৭ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা তুলনায় ৯ হাজার ৪শ ৮৭ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন আখ বেশি মাড়াই করেছে। তবে চিনি আহরণের হার কমে যাওয়ায় অল্পের জন্য পৌঁছাতে পারেনি চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায়। ৫ হাজার ২শ ৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ৪ হাজার ৯শ ২০ মেট্রিক টন। ফলে ১৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আখেরি হুঁইসেল বাজিয়ে সম্পন্ন হয় ২০১২-১৩ আখমাড়াই মরসুমের কার্যক্রম। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ২০১৩-১৪ আখমাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সর্বাত্বক চেষ্টা চালায়।

কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ গত বছরের ২৯ নভেম্বর ২০১৩-১৪ আখমাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিয়ে পথ চলছিলো। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের নিদের্শনায় সে পথচলা বন্ধ হয়ে যায়। করপোরেশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ২০১৩-১৪ আখমাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কর্পোরশনের পক্ষ থেকে এ মরসুমে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেয়। সে হিসেব অনুযায়ী ৯১ মাড়াই দিবসে কেরুজ চিনিকলে ৮ হাজার ২শ মেট্রিক টন চিনি করতে হবে। চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৫০। তবে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে কৃষক ও চিনিকলের নিজস্ব ৯ হাজার ৫শ ১০ একর জমিতে আখ ছিলো। এর মধ্যে চিনিকলের নিজস্ব জমির পরিমাণ ১ হাজার ১শ ৮২ একর। এতে বীজ আখ বাদে মিলে আখ মাড়াই করা হতে পারে ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। যা ৯১ দিবসে মাড়াই করে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২শ ৭৫ মেট্রিক টন। চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০।

এদিকে এ মরসুমের উৎপাদিত চিনি রাখা নিয়ে মহাচিন্তায় পড়তে হয় মিল কর্তৃপক্ষ। গত পরপর তিন মাড়াই মরসুমের উৎপাদিত চিনি অবিক্রিত হয়ে গোডাউনে পড়ে ছিলো। আখ মাড়াই শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিনি বিক্রি হওয়ায় গোডাউনের কিছু জায়গা খালি হয়। এরপরও মিলের ৫টি গোডাউনে এখনো অবিক্রিত চিনির পরিমাণ ৬ হাজার ৯শ ১৫ পয়েন্ট ০৫ মেট্রিক টন। যা বর্তমান বাজার মূল্য ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ৫শ টাকা। মিলের ৫টি গোডউন চিনিতে কানায় কানায় ভর্তি থাকায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে মিল কর্তৃপক্ষ। বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চলতি মাড়াই মরসুমের উৎপাদিত চিনি রাখার স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে কেরুজ চিনিকলের বন্ধ হয়ে থাকা ওষুধ গোডাউন, পরিবহন বিভাগের ইঞ্জিন গোডাউন, সিজিনাল ব্র্যাকের ১৩টি কক্ষ, প্রাইমারি স্কুলের ৭টি কক্ষ, অফিসার্স ও সাধারণ ক্লাব, আবাসিক এলাকার খালি পড়ে থাকা কয়েকটি ভবনসহ বিভিন্ন স্থান। সে জন্যে মিল কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়েছে। যা মিলের জন্য পরণিত হয়েছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো।

কেরুজ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) ইউসুফ আলী শিকদারের কাছ থেকে জানা গেছে, গতকাল সোমবার ছিলো চলতি মরসুমের ১০২ মাড়াই দিবস। এ দিবস পর্যন্ত চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১ লাখ ৯ হাজার ৭শ ১০ মেট্রিক টন। এখনো মাঠে আখ রয়েছে প্রায় ১০/১২ হাজার মেট্রিক টন। যা দিয়ে মাড়াই করতে সময় লাগতে পারে প্রায় দু সপ্তা। তবে সেক্ষত্রে মিলটি যদি কোনো প্রকার বড় ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে না পড়ে তা হলে বাকি মাড়াই দিবস পর্যন্ত মিলে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আখমাড়াই করা হতে পারে। গতকাল পর্যন্ত ১ লাখ ৯ হাজার ৭শ ১০ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ২শ ২৫ মেট্রিক টন। আরো ১ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চলতি মরসুমে চিনি উৎপাদন হবে ৮ হাজার ২শ ২৫ মেট্রিক টন। চলতি মাড়াই মরসুমে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত লক্ষমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৫/২৬ দিন অতিক্রম করবে। সে তুলনায় চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তেমন বেশি হচ্ছে না। কারণ হিসেবে রয়েছে চিনি আহরণের গড় হার ৬ দশমিক ৬৮।

এদিকে চলতি মরসুমের উৎপাদিত চিনি পূর্ব পরিকল্পনায় অনুযায়ী রাখা হলেও এ চিনি বিক্রি না হলে আগামী মরসুমের উৎপাদিত চিনি রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। সম্প্রতি সরকার নির্ধারিত প্রতি কেজি চিনি ৫০ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা কমিয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এতেও হয়নি কোনো সুফল। কারণ সরকারের নির্ধারিত প্রতি কেজি চিনির মূল্য যখন ৫০ টাকা ছিলো তখন দেশের বেসরকারি ভাবে উৎপাদিত চিনির বাজার মূল্য ছিলো আরো কম। বর্তমানে ৪০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হলেও বেরসকারিভাবে উৎপাদিত চিনির বাজার মূল্য ৩৮ টাকা। সরকারের তুলনায় সব সময় তারা চিনির মূল্য ২ টাকা কমিয়ে রাখায় ক্রেতা সাধারণ ওই চিনির দিকেই ঝুঁকে পড়ছে।

কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবীদ আজিজুর রহমান বলেছেন, বেসরকারিভাবে উৎপাদিত চিনির তুলনায় কেরুজসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত চিনির মান অনেক উন্নত ও মিষ্টি বেশি। ঝকঝকে ঝরঝরে চিনির দিকে আকৃষ্ট হয়ে ক্রেতা সাধারণ ঠকছে। তাই তিনি বেশি বেশি করে কেরুজ উৎপাদিত চিনি কেনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। চিনি বিক্রির ক্ষেত্রে এ ধরনের দশার কারণেই অনেকই অভিযোগ করে বলেছে, গত আখ মাড়াই মরসুমে চিনি কারখানায় লোকসান গুনেছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। চলতি বছরে লোকসানের অঙ্ক খুব কম হবে না। যা আগের ধারাবাহিকতা পেরিয়ে যেতে পারে। ৭৫ বছর বয়সী এ মিলটিকে টিকিয়ে রাখতে কৃষকরা বেশি বেশি আখচাষ না করলে আগামীতেও এ লোকসানের বোঝা টানতে হবে।

চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবীদ আজিজুর রহমান আরো বলেন, আগামী ২০১৪-১৫ আখমাড়াই মরসুমের আগাম প্রস্তুতির লক্ষ্যে গ্রহণ করা হচ্ছে নানামুখি কার্যক্রম। বেশি বেশি আখ রোপণের জন্য কৃষকদের করা হচ্ছে আগ্রহী। নিশ্চিত করা হচ্ছে আখচাষিদের সুযোগ সুবিধা। সে ক্ষেত্রে মিলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সকলকে নিষ্টা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। নিজ নিজ কাজে হতে হবে আন্তরিক। তাহলেই একদিকে যেমন আখচাষ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে সরকারের মূল্যবান সম্পদ চিনিশিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।