অপহৃত কম্পিউটার ব্যবসায়ী আবু শামা ও মাসুদ রানার শ্বাসরুদ্ধকর ৫ দিন

 


মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরায় নিজ গ্রামে মান্নতের ক্ষির বিতরণ

সদরুল নিপুল: মনে মনে মান্নত করেছিলাম আমার ছেলে যেদিন ফিরে আসবে সেদিন গ্রামের সব নাবালক-নাবালিকা ছেলে-মেয়েদের মাঝে ক্ষির বিতরণ করবো। এজন্য এখন ক্ষির রান্না করা হচ্ছে। অপহরণের দিন থেকে একটানা ৫ দিন কীভাবে পার করেছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। এ ৫টি দিন মনে হয়েছে ৫টি বছর। গতকাল শুক্রবার বিকেলে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন অপহরকচক্রের ডেরায় ৫দিন বন্দির পর মুক্ত হওয়া আবু শামার মা মর্জিনা খাতুন।

অপহৃত চুয়াডাঙ্গার কম্পিউটার ব্যবসায়ী আবু শামা জানান, অপহরণের দিন থেকে ৫ দিন একটি কুড়ে ঘরের ভেতর সব সময় আমাদের পিঠ মোড়া করে বেঁধে রাখতো। চোখও সব সময় বেঁধে রাখতো। একটানা ৫ দিন যেমন গোসল করতে দেয়নি তেমনই প্রতিটি দিন মৃত্যুর কথা ভেবে ঘুমাতেও পারিনি। আমরা যে ফিরে আসবো বা প্রাণ ফিরে পাবো তা কখনও চিন্তা করিনি। অভিন্ন ভাষায় তার কর্মচারী মাসুদ রানা জানান, সে এক বিভৎসময় দিনের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

গতকাল বিকেলে সরেজমিনে নিমতলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আবু শামা এবং মাসুদ রানার বাড়িতে অসংখ্য নারী-পুরুষের ভিড়। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলাকাবাসীসহ দূর দূরান্ত থেকে অনেকে ছুটে এসেছে দুজনকে একনজর দেখার জন্য। আবু শামার বাড়ির এক পাশে চলছিলো ক্ষির রান্নার কাজ। অপহরকদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া কম্পিউটার ব্যবসায়ী আবু শামা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাথাভাঙ্গাকে জানান, গত ৮ মার্চ শনিবার রাত ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রতিদিনের মতো কর্মচারী প্রতিবেশী মাসুদ রানাকে সাথে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে নিজ বাড়ি নিমতলা গ্রামের উদ্দেশে ফিরছিলাম। আসার পথে কুলচারা-গোপালনগর সড়কের মাঝামাঝি একটি নির্জন ফাঁকা মাঠের সামনে অটো গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। এরপর ৮-১০ জন ধারালো অস্ত্রসহ আমাদের জিম্মি করে মাথা নিচু করতে বলে একটি ভুট্টাক্ষেতের ভেতর নিয়ে গিয়ে হাত-মুখ-চোখ বেঁধে ফেলে। আধা ঘণ্টা পর একটি মাইক্রোবাস আসে। এ মাইক্রোবাসে আমাদের দুজনকে তুলে নিয়ে যায়। চোখ বাঁধা থাকার কারণে কোথায় কোনো দিকে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারিনি। প্রায় দু ঘণ্টা পর আমাদের মাইক্রো থেকে নামিয়ে এক কিলোমিটারেরও বেশি পায়ে হেঁটে একটি কুড়ে ঘরের ভেতর আটকে  রাখে। গত রোববার সন্ধ্যায় আমার মোবাইলফোন দিয়ে অপহরণকারীদের একজন প্রথমে আমার পিতার সাথে কথাবলার সুযোগ দেয়। এরপর ওরা আমার পিতার কাছে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। খাবারের কথা জানতে চাইলে আবু শামা বলেন, তিন বেলা হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসে চোখ বাঁধা থাকার কারণে ওরাই হাত দিয়ে মুখে খাবার তুলে দিতো। সকালে দিতো ডাল দিয়ে পরটা। দুপুরে ভাতের সাথে কোনো দিন ডিম কোনো দিন মাংস দিতো। রাতে দিতো খেঁজুর গুড়ের সাথে রুটি। রাতে কুড়ে ঘরের ভেতর বিচুলি ছড়ানোর ওপর শুয়ে থাকতাম। সব সময় কয়েকজন আমাদের পাহারা দিয়ে রাখতো। ঘরের চারিদিকে শুধু ফাঁকা মাঠ এবং বিল। কোনো মানুষজন বা বাড়িঘর নেই। একদিকে ৫ দিন গোসল করা হয়নি আবার আতঙ্ক আমদের অসুস্থ করে ফেলে। আমরা কয়েকবার পালানোর সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু প্রাণের ভয়ে পালায়নি। ওরা ভয়ঙ্কর হলেও কোনোদিন মারধর করেনি। গত বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের একটু আগে বুঝতে পারি আশপাশে কেউ নেই। সব সময় চোখবাঁধা থাকলেও আমরা অল্প অল্প দেখতাম। আমি মাসুদ রানাকে বলি এখনই পালাতে হবে। যেমন কথা তেমনই কাজ। আমি প্রথমে মাসুদ রানার বাঁধন খুলে দিই এরপর ও আমার বাঁধন খুলে দেয়। এরপর আমরা দুজন নির্জন ফাঁকা মাঠ বিলের পাশ দিয়ে এক কিলোমিটারেরও বেশি দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে একটি গ্রাম দেখতে পায়। গ্রামের ভেতর গিয়ে জানতে পারি গ্রামের নাম ঝিনাইদহ সদরের গাঙনা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর। মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে লক্ষ্মীপুর জামে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে সবাইকে ঘটনা সম্পর্কে বলি। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস করতে চাইলো না। বরং ভাবলো আমরা অপরাধ জগতের মানুষ। এরপর একই গ্রামের অন্য এক পাড়ায় গিয়ে বেশ কয়েকজনকে জানালে তারা বিশ্বাস করে রাত একটা পর্যন্ত রেখে দেয়। এরপর এক ব্যক্তির মোবাইলফোন দিয়ে আমার পিতার কাছে ফোন করলে উনি চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশকে জানায়। চুয়াডাঙ্গার এএসপি মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের সহযোগিতায় রাত ২ টা ৩০ মিনিটের সময় উদ্ধার করে সাড়ে ৩টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় নিয়ে আসে। গতকাল সকালে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুপুরে আবু শামা ও মাসুদ রানা তাদের নিজ গ্রাম জেলা সদরের পদ্মবিলা ইউনিয়নের নিমতলা গ্রামে ফিরে যায়। দুপুরে নিমতলা গ্রামে দুজন ফিরে আসার খবর শুনে এবং দৈনিক মাথাভাঙ্গা পেপারে দেখে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব এলাকাবাসীসহ দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটে আসে। ছেলেকে কাছে পেয়ে আবু শামার মা মর্জিনা খাতুন আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তেমনই মাসুদ রানার মা আকলিমা খাতুন এক বাধ ভাঙা আনন্দের কারণে নীরবে দু চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকেন।

উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গার কম্পিউটার ব্যবসায়ী নিমতলা গ্রামের কুদরত আলীর একমাত্র ছেলে আবু শামা (২৬) এবং একই গ্রামের তার কর্মচারী আফাজ উদ্দীনের বড় ছেলে মাসুদ রানা (২০) গত ৮ মার্চ রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে কুলচারা-গোপালনগর সড়কের মাঝামাঝি অপহরণকারীদের কবলে পড়ে।