স্টাফ রিপোর্টার: তৃতীয় ধাপের ৮১ উপজেলায় এবার শুরু হচ্ছে ভোটের লড়াই। কাল শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে এ ভোট গ্রহণ। গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। বন্ধ আছে সব ধরনের যান্ত্রিক যান চলাচল। এখন জয়-পরাজয়ের হিসাব কষছেন প্রার্থী-ভোটাররা। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান এ তিন পদে জয়ী হতে লড়ছেন ১১১৯ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৪১৯, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪২৩ এবং সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৭৭ জন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, যে কোনো মূলে নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধ করা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নির্বাচনকে সহিংসতামুক্ত রাখতে মোতায়েন রয়েছে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উপজেলা পর্যায়ে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। পর্যাপ্ত ৱ্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যও মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে ব্যালট ব্যাক্স, পেপার, কলম, পেন্সিল, অমোচনীয় কালি, রাবার ও স্কেলসহ ভোট গ্রহণের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ। ভোটগ্রহণ উপলক্ষে ৮১ উপজেলায় শনিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে ইসি। আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনের ৩২ ঘণ্টা আগে থেকে সকল প্রচার-প্রচারণা বন্ধ থাকবে। তা অব্যাহত থাকবে নির্বাচনের পর ৬৪ ঘন্টা পর্যন্ত। তবে ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। তাই ভোটগ্রহণের পর ৬৪ ঘন্টা পর্যন্ত সব ধরনের শোভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এ সময়ে কিছুটা কমিয়ে আনা হচ্ছে। তবে কেউ আইন ভঙ্গ করলে কারাদণ্ড ও আর্থিক দণ্ডেদণ্ডিত হবেন। এমনকি প্রার্থিতাও বাতিল হবে। ৪১ জেলার সমসংখ্যাক রিটার্নিং অফিসার এবং ৮১ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ রয়েছে।
এদিকে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় প্রার্থী বিজয়ী করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর বিভক্ত দেখা দিয়েছে এবং সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। দিন যতোই যাচ্ছে সংঘাতের ঘটনা ততোই বাড়ছে। নির্দলীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে তৃতীয় ধাপে নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনী সহিংসতাও বেড়েছে। সহিংসতার কারণে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, ধাপে ধাপে নির্বাচন করার কারণে দ্বিতীয় ধাপে কিছু সহিংসতা হয়েছে। প্রথম ধাপের ফলাফল আগে জেনে যাওয়ার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো পরের ধাপে প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে আরো তত্পর হয়ে উঠে। এজন্য সহিংসতা হয়। এজন্য ধাপে ধাপে নির্বাচন করাটা ভুল ছিলো বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে নির্বাচনে সহিংসতা হয়ে থাকে। তবে আমরা শক্ত অবস্থানে রয়েছি। তাই সহিংসতা তুলনামূলক কম হচ্ছে। আগামীকাল ৮১ উপজেলায় নির্বাচনে অন্যান্য বাহিনীকে সহায়তা করতে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে ১২ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। প্রতিটি উপজেলায় ১ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩৪ সদস্য) করে এ ফোর্স কাজ করবে। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের কারণে কোনো অপরাধীকে আটকের ক্ষমতা নেই সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তারা সব কিছু করবেন। ভোটগ্রহণে সেনাবাহিনীর সহযোগিতার বিষয়ে আবু হাফিজ বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী নির্বাচন কর্মকর্তাদের ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এর মধ্যে ৱ্যাব ও বিজিবি রয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় ১জন বিচারক ও ৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ নির্বাচনে ভোটারদের ভোটদানে সহায়তার জন্য ৫ হাজার ৪৪৪ জন প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ৩৫ হাজার ৩৩১ জন এবং পোলিং অফিসার ৭০ হাজার ৬৬২ জন। আর ভোটকেন্দ্র ৫ হাজার ৪৪৪টি, কক্ষ ৩৫ হাজার ৩৩১টি। ইসির তথ্যমতে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১ জন প্রিসাইডিং অফিসার এবং প্রতিটি কক্ষে ১ জন সহকারী প্রিজাইডিং ও ২ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। ৮১ উপজেলায় ভোটার ও ব্যালট ৪১ জেলার ৮১ উপজেলায় মোট ১ কোটি ৩১ লাখ ৮৫ হাজার ১৩ জন ভোটার। পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। দেখা গেছে, ৬৬০০১৩১ জন নারী এবং ৬৫৬৭৮৩২ জন পুরুষ ভোটার। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান এ তিন পদের বিপরীতে মোট ব্যালট ছাপা হয়েছে ১৩১৮৫০১৩টি।
সংখ্যালঘু এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ২১৩ উপজেলার নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে ইসি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর এলাকায় নজরদারি ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিজ এলাকায় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা এবং পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী দেখতে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। নির্বাচন কমিশনও এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে দলগুলোর কাছে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নেয় কমিশন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তা পাঠাতে পারেনি বলে নির্বাচনী শাখার কর্মকর্তারা জানান।
কাল ভোট যেসব উপজেলায় এবার যে ৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হবে তা হলো- ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর, দিনাজপুরের সদর ও নবাবগঞ্জ, নীলফামারীর সদর, লালমনিরহাটের আদিতমারী, কুড়িগ্রামের সদর, রৌমারী ও চিলমারী, গাইবান্ধার সদর ও সাদুল্লাপুর, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, ভোলাহাট ও শিবগঞ্জ, নওগাঁর মান্দা, পোরশা ও ধামুইরহাট, রাজশাহীর গোদাগাড়ি, চারঘাট ও দুর্গাপুর, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা, যশোরের মনিরামপুর, নড়াইলের লোহাগড়া, বাগেরহাটের সদর, মোরেলগঞ্জ, রামপাল, মোংলা ও শরণখোলা, খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, ভোলার সদর, বরিশালের মুলাদী, হিজলা ও বাবুগঞ্জ, পিরোজপুরের নেছারাবাদ, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, শেরপুরের শ্রীবর্দী, ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা, ফুলপুর ও ধোবাউড়া, নেত্রকোনার সদর ও মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের সদর, কুলিয়ারচর ও হোসেনপুর, ফরিদপুরের সদর, আলফাডাংগা ও সদরপুর, চরভদ্রাসন, ভাংগা ও মধুখালী, গোপালগঞ্জের টুংগীপাড়া, শরীয়তপুরের সদর ও নড়িয়া, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, সিলেটের সুরমা, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী ও দেলদুয়ার, কুমিল্লার নাংগলকোট, হোমনা, বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণপাড়া, তিতাস, চাঁদপুরের কচুয়া ও হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর সেনবাগ, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সীতাকুণ্ড, রাঙ্গামাটির বরকল, বাঘাইছড়ি ও কাউখালি, মানিকগঞ্জের ঘিওর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, ফেনীর দাগনভূঁইয়া এবং বান্দরবান জেলার বান্দরবান সদর ও আলী কদম। উল্লেখ্য, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৮৩ উপজেলা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে ইসি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দু গ্রুপের মধ্যে সহিংসতা ও সংঘর্ষের কারণে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচন স্থগিত হয়। সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা এবং আদালতের নির্দেশে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের নির্বাচনটি বন্ধ রয়েছে।