ঢাকায় পুলিশ দম্পতি হত্যামামলা :ঐশীসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। এতে নিহত দম্পতির একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অপর আসামিরা হলো- গৃহপরিচারিকা খাদিজা খাতুন সুমি, ঐশীর বন্ধু আসাদুজ্জামান ওরফে জনি ও মিজানুর রহমান রনি। গতকাল রোববার বেলা ১২টায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের মাতব্বর চার্জশিট জমা দেন। অভিযুক্ত গৃহপরিচারিকা সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তাকে কিশোর আদালতের মুখোমুখি করার জন্য পৃথক একটি অভিযোগপত্রও দেয়া হয়েছে।

গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর ২নং চামেলীবাগের বাসার বি-৫ ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করা হয়। মা-বাবা খুন হওয়ার পর রহস্যজনকভাবে পালিয়ে যায় ঐশী। এ ঘটনায় ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোটভাই মশিহুর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই দুপুর দেড়টার দিকে পল্টন থানায় গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কাজের মেয়ে সুমিসহ ধরা দেয় ঐশী। পরে পর্যায়ক্রমে ঐশীর অপর দু বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

আদালতে জমা দেয়া চার্জশিটে বলা হয়েছে, ঐশী রহমান অত্যন্ত চতুর ও কৌশলী। পরিবারের প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাদে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের অত্যন্ত আদরের ছিলো। এ সুযোগে সে অবাধ স্বাধীনতার প্রতি ক্রমান্বয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং জনি ও রনির মতো উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরিবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পর্যায়ক্রমে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গাঁজা, ইয়াবা ও সিসার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

হত্যাকাণ্ডের ২/৩ মাস আগে ঐশীর বন্ধু জনি তাকে ড্যান্স করার জন্য দুবাই যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এ জন্য ঐশী বাবার কাছে ৩০ হাজার টাকা চায়। বাবা মাহফুজুর রহমান টাকা না দিয়ে তাকে দুবাই যেতে নিষেধ করে। একারণে হত্যাকাণ্ডের এক মাস আগে ঐশী বাসা থেকে রাগ করে বেরিয়ে যায় এবং বন্ধু জনির সহায়তায় বাড্ডা এলাকার এক বাসায় সাবলেট থাকে। বাবা-মা তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে বাসায় একধরনের বন্দি করে রাখে। এ জন্য সে বাবা-মার প্রতি আরো বেশি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

ঐশীকে চতুর উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, ঘটনার পর ঐশী সজ্ঞানে এবং অপরাধ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ছিলো। এ কারণে সে নিজের মোবাইলফোন ব্যবহার না করে তার মা স্বপ্না রহমানের মোবাইলফোন ব্যবহার করে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা বলে বাসা থেকে মালামাল নিয়ে পালিয়েছিলো। এমনকি আলামত নষ্ট করার জন্য সে হত্যাকাণ্ডের পর ছুরি ও রক্তের ছাপ ধুয়ে ফেলে। ছোট ভাই ওহী রহমান যেন সাক্ষী দিতে না পারে এ জন্য তাকে বাথরুমে আটকে রাখে। হত্যাকাণ্ডের পর অভিজ্ঞ খুনির মতো ঐশী নিজের মায়ের হাতের স্বর্ণের চুড়ি ও আংটি খুলে নিয়েছে। এমনকি রাতে হত্যাকাণ্ডের পর ঠাণ্ডা মাথায় গোসল সেরে গৃহপরিচারিকা দিয়ে আলুর চিপ ভেজে খেয়েছে। নিজের পোশাক গুছিয়ে আলমারি থেকে আরো কিছু স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে সকালে ভাই ও গৃহপরিচারিকাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বাসা থেকে বেরোনোর সময় সে নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে চাতুরতা করে খালার বাসায় যাওয়ার মিথ্যা তথ্য দিয়ে বেরিয়ে যায়।

খুনের বিবরণ দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন পরিকল্পনা করে দু ধরনের ঘুমের ওষুধ এনে কফির সাথে মিশিয়ে প্রথমে মাকে ও পরে বাবাকে খাওয়ায়। এতে দুজনই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকলে রাত ২টার দিকে সে প্রথমে মায়ের বুকে ছুরি চালায় ও গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে বাবাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ঐশীকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোচিকিৎসকের কাছেও নেয়া হয়। এছাড়া, তার বয়স নিশ্চিত করার জন্য যেই ক্লিনিকে তার জন্ম হয়েছে এবং খুলনা থেকে ঢাকায় এনে প্রথম স্কুলে ভর্তির কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়। এতে ঐশীর বয়স ১৯ বলে প্রমাণিত হয়।

এছাড়া, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সে হত্যাকাণ্ডের আগে হুইস্কি পান করেছিল বললেও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আদালতে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে ৫৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আর ৮টি জব্দ তালিকামূলে প্রায় ৮০ প্রকার আলামত জব্দ করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে গৃহপরিচারিকা সুমিকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা ও দু বন্ধুর বিরুদ্ধে প্ররোচণার অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে ঐশী কাশিমপুর কারাগারের মহিলা সেলে ও গৃহপরিচারিকা সুমী গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন সংশোধনী কেন্দ্রে রয়েছে। এছাড়া, তার দু বন্ধু জনি ও রনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে।