ঝিনাইদহ অফিস: অপহরণ আতঙ্কে বসবাস করছেন ঝিনাইদহের মানুষ। সাধারণ বাসিন্দা থেকে শুরু করে বিত্তশালী সবার মনেই এখন অপহরণ আতঙ্ক। গত এক মাসে জেলার ৬ উপজেলায় নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। অপহরণকারীরা কৌশলে মুক্তিপণ দাবি ও আদায় করছে। আর যারা মুক্তিপণ দিতে পারছেন না তাদেরকে ফিরতে হচ্ছে লাশ হয়ে। প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপহরণকারীরা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের সাথে গোপন সম্পর্কের কারণে গ্রেফতার করা হচ্ছে না অপরাধীদের।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান জানান, ঝিনাইদহ একটি সন্ত্রাস কবলিত জেলা। এখানে প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। তবে অপরাধীদের গ্রেফতার পুলিশের অভিযান চলছে। মানুষের অপহরণ আতঙ্ক বিষয়ে তিনি বলেন, দু-একটি ঘটনা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছুই নেই। অপহরণ আতঙ্কে বসবাসকারীদের নিকটবর্তী থানায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
জানা গেছে, মুক্তিপণের দাবিতে ঝিনাইদহের ৬ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে অপহরণ করছে দুর্বৃত্তরা। মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে অপহৃত ব্যক্তিকে খুন করে রাতের আঁধারে ফেলে দেয়া হচ্ছে খাল-বিলে। অভিযোগ উঠেছে, আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও থানা পুলিশ অপরাধীদের আশ্রয় প্রশয় দিচ্ছে।
নিখোঁজের ৩ দিন পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি শৈলকুপা উপজেলার শ্রীরামপুর হাইওয়ে ব্রিজের নিচ থেকে লক্ষ্মী রাণী অধিকারী নামে ৪ বছর বয়সী এক শিশুর বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া যায়। তার মুখে টেপ জড়ানো ছিলো। নাক-কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। নিহতের বসন্তপুর গ্রামের নেপাল চন্দ্র জানান, নিখোঁজের পর থেকে তার শ্বশুরের কাছে মোবাইলফোনে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে আসছিলো অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় শৈলকুপা থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
৩ মার্চ শৈলকুপা উপজেলার সিদ্ধি গ্রামের ময়েন উদ্দিন (৫২) টর্চলাইটে চার্জ দেয়ার জন্য পাশের আমতলা বাজারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। রাতে অনেক খোঁজাখুজি করেও পিতাকে পাওয়া যায়নি বলে জানান তার ছেলে উজ্জ্বল বিশ্বাস। সকালে এলাকাবাসী গ্রামের মাঠে গমক্ষেতে তার পিতার গলা কাটা লাশ দেখতে পান। সিদ্ধি গ্রামের ইউপি সদস্য বছির উদ্দিন জানান, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় এবং আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ঝিনাইদহ শহর থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের কিং ব্র্যান্ড সিমেন্টের ডিস্ট্রিবউটর তারিকুল ইসলাম মোহনকে (৪৫) অপহরণ করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শহরের শেরেবাংলা সড়কের নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেঘনা ট্রেডার্স থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন তিনি। এরপর মোবাইলফোনে পরিবারের নিকট এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ ঘটনায় অপহৃতের পিতা আমিনুল ইসলাম ঝিনাইদহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। শুক্রবার অপহৃত মোহন বাড়ি ফিরে এসেছেন।
গত ২ মার্চ রোববার রাতে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মিয়াকুণ্ডু গ্রাম থেকে অস্ত্রের মুখে রুকাইয়া খাতুন (১৭) নামে এক কলেজছাত্রীকে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। সে নারিকেলবাড়িয়া আমেনা খাতুন ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের ছাত্রী। অপহৃত কলেজছাত্রীর পিতা আব্দুল কুদ্দুস জানান, বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার পথে একই গ্রামের লুৎফর লস্করের বখাটে ছেলে আক্তারুল ইসলাম প্রায়ই তার মেয়েকে উত্যক্ত করতো। গত রোববার রাতে দুটি মোটরসাইকেলযোগে আক্তারুল, টুকু লস্কার, বিল্লাল ও শিমুল নামে চার যুবক তার মেয়েকে বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় অপহৃতের পিতা আব্দুল কুদ্দুস বাদী হয়ে চারজনকে আসামি করে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেছেন। তবে অপহরণকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা তুলে নিতে তাকে চাপ প্রয়োগ করছে। পুলিশ এখনও অপহৃত কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করতে পারেনি। তবে এ ঘটনায় টুকু লস্কার নামে এক বখাটে যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
গত পয়লা মার্চ শনিবার রাতে মহেশপুর উপজেলার পুরন্দরপুর গ্রাম থেকে পুলিশ পরিচয়ে জাকির হোসেন ও আলমগীর হোসেন নামে দু ভাইকে অপহরণ করা হয়েছে। এক সপ্তা পেরিয়ে গেলেও তাদের সন্ধান মেলেনি। পরিবারের লোকজন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অপহৃত জাকিরের স্ত্রী পারভীন বেগম জানিয়েছেন, রাতে পুলিশ পরিচয় দিয়ে অস্ত্রধারী ৮/৯ জন লোক মাইক্রোবাসযোগে বাড়িতে প্রবেশ করে দু ভাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বলে। পরদিন সকালে মহেশপুর থানায় খোঁজ করলে বলা হয় ওই নামে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। পুরন্দরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার আব্দুস সালাম বাচ্চু জানান, গুম হওয়া দু ভাই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। তারা পেশায় মাংশ বিক্রেতা। অপহৃত জাকির ও আলমগীরের পিতা আব্দুস সাত্তার অভিযোগ করেন, ঘটনারদিন রাতে গ্রামের চৌকিদার হারুন তাদের বাড়ি চিনিয়ে দেন।
এদিকে গত মাসের প্রথম সপ্তায় কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে ইব্রাহীম (১৭) ও ফরাশপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনের নাতি সাজ্জাদুল ইসলাম (১৩) অপহৃত হয়েছেন। ফরাশপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিন জানান, তার বাড়িতে থেকে নাতি সাজ্জাদুল ইসলাম মস্তবাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। বই কিনতে বাড়ি থেকে কালীগঞ্জ শহরে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি। এক মাস ধরে খোঁজাখুজির পরও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের নুর ইসলাম জানান, ১৬ দিন আগে বাড়ি থেকে কালীগঞ্জ শহরে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা তার ছেলেকে অপহরণ করে। এখনও পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। একই গ্রামের ওলিয়ারের ছেলে তানিম আহম্মেদ তুষারকে অপহরণের ৯ দিন পর মুক্তিপণ নিয়ে ফেরত দিয়েছে অপহরণকারীরা।