বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি একরকম চূড়ান্তই বলা যায়। দাম বৃদ্ধির গণশুনানি শেষ হয়েছে। ১০ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে দাম বৃদ্ধির রায় ঘোষণা করতে পারে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গড়ে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর রায় আসতে পারে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে চলতি মাস থেকেই গ্রাহকদের দিতে হবে বিদ্যুতের বাড়তি দাম। বিগত মহাজোট সরকারের আমলে ছয় দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিলো। জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর আবারও বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। প্রশ্ন হলো, কেন এতো ঘন ঘন দাম বৃদ্ধি? এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে পিডিবি যুক্তি দিয়েছে, অপচয় ও চাহিদা কমানোই তাদের লক্ষ্য। তবে সত্য হলো, তেলভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্য সমন্বয় করার জন্যই মূলত দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে। বস্তুত পাঁচ বছর ধরে বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার রেন্টাল ও কুইকরেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করে আসছে। উল্লেখ্য, এসব কেন্দ্রের সিংহভাগই তেলচালিত। তাই বিদ্যুত উৎপাদনের খরচ বেশি। রেন্টাল ও কুইকরেন্টালকে সহায়তা করতে গিয়ে সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ করেছে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় করা হয়েছে কেবল ভর্তুকি বাবদ। তাছাড়া রেন্টাল খাতে অপচয় ও দুর্নীতিরও জোরালো অভিযোগ আছে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে রেন্টাল বিদ্যুতের দায় চাপানো হচ্ছে গ্রাহকদের ওপর। এটা অযৌক্তিক ও অন্যায়।
প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুত খাতে সরকার গৃহীত ভ্রান্তনীতির কারণেই আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার শুরুতে রেন্টালের ওপর নির্ভর করলেও ক্রমান্বয়ে দেশে বড় বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে তুললে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সরকারের লক্ষ্যও ছিলো তাই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, বড় বড় বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে উঠলে ২০১৩-২০১৪ সাল নাগাদ বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বড় বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুতের দামে সামঞ্জস্য আনার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো, তা বাস্তবায়ন করা হলো না কেন? দেশে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ আছে সত্য, তবে তা মীমাংসার যথাযথ উদ্যোগ কি সরকার নিয়েছে? বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করেও তো বড় বিদ্যুতকেন্দ্র চালানো যেতো।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেলে সবচেয়ে বিপাকে পড়বে সীমিত আয়ের মানুষ। গ্রাহকদের শ্রেণিভেদে দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, গরিব আবাসিক গ্রাহকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ পড়বে সবচেয়ে বেশি। তবে আবাসিক খাতেই শুধু নয়, শিল্প খাতেও পড়বে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব। শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। এর মাশুলও দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট আয় ও পেশার মানুষের কষ্ট ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। অনেক পরিবার ভবিষ্যতের ভাবনা ভুলে সঞ্চয়ের অর্থও খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় আবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার স্ফীত করার মাধ্যমে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি খাতেও। কৃষকরা এমনিতেই উৎপাদন খরচের তুলনায় উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পান না সব মরসুমে। তার ওপর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-অবরোধে তাদের ব্যাপক লোকসান দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্প খাতও। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে এসব বিষয় বিবেচনায় আনা উচিত বলে আমরা মনে করি।