স্টাফ রিপোর্টার: পল্লী বিদ্যুত সমিতিসমূহের গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের খুচরা মূল্য গড়ে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। এ প্রস্তাবের আওতায় সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বোর্ড। ফলে প্রায় দু লাখ সেচ পাম্পের মালিককে অতিরিক্ত বিদ্যুত বিল গুনতে হবে। এর প্রভাব পড়বে প্রান্তিক কৃষকদের ওপর। বাড়বে ফসলের উৎপাদন খরচ। তবে সরকার তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ভর্তুকি দিলে সেচখাতে দাম বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছে আরইবি। এদিকে এখন দাম না কমলেও ভবিষ্যতে দাম কমতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান এ আর খান। গতকাল বিইআরসি আয়োজিত গণশুনানি শেষে তিনি এ আশ্বাস দেন। গণশুনানিতে আরও অংশ নেন সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন ও মাকসুদুল হক। তিনদিনব্যাপি শুনানির শেষ দিনে বৃহস্পতিবার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিন শুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, গ্রাহকের পরিমাণ বেশি হলেও তাদের বিদ্যুত ব্যবহারের পরিমাণ কম। ৮৫ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে ৯ লাখ গ্রাহক ১৫ ইউনিট বিদ্যুত খরচ করে মাসে মাত্র ৯০ টাকা বিল দেয়। ৫৫ লাখ গ্রাহক মাসে গড়ে মাত্র ৩১ ইউনিট বিদ্যুত খরচ করে ১৩৬ টাকা বিল দেয়। চলতি বছরে ২ লাখ ৮৮ হাজার সেচ গ্রাহককে সমিতিগুলো বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সমিতিগুলো নতুন উপকেন্দ্র, ৩৩ কেভি ফিডার ও ১১ কেভি ফিডার নির্মাণ করতে পারছে না। ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছরে কয়েক শ কোটি টাকা প্রতিস্থাপন কাজে ব্যয় হয়। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির সমতুল্য করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় পল্লী বিদ্যুত সমিতির গ্রাহকদের জন্য গড়ে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত বলে মনে করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। বোর্ড জানায়, বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে চলতি অর্থবছরে আবাসিক খাতে লোকসান দিতে হবে ৬৬২ কোটি টাকা। বোর্ডের প্রস্তার অনুসারে বর্তমানে আবাসিক সংযোগে ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের জন্য ৫.৯০%, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৯.১৭%, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের জন্য ১৭.০২%, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের জন্য ৭.৯১%, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের জন্য ৯.৮৯% ও ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারকারীদের জন্য ৫.৫৪% দাম বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ৫.৫৬%, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০.৬২%, সেচ গ্রাহকদের ২৩.০৪%, ক্ষুদ্রশিল্পে ১৫.১১%, বৃহৎশিল্পে ১০.১৩%, রাস্তার বাতির ক্ষেত্রে ৮.০২% ও ৩৩ কেভি গ্রাহকদের জন্য ১৪.২০% দাম বাড়ানো প্রয়োজন। এ প্রস্তাবে বেশি চাপ পড়বে ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর- যাদের নিজস্ব পাম্প নেই। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের তথ্য অনুসারে কেবলমাত্র সেচখাতে ১৬০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুত সরবরাহের কারণে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে তাদের ২৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আরইবির মোট গ্রাহকের ৮৮% আবাসিক ও সেচ গ্রাহক। বর্তমানে তাদের সেচ গ্রাহকের সংখ্যা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৫২- যা দেশের মোট সেচ গ্রাহকের ৯০% এর বেশি। এদের মধ্যে ৬৫%-এর জন্য বিক্রয়মূল্য ক্রয়মূল্যের চেয়েও কম। বর্তমানে সেচ রিটেইল ট্যারিফ (৩.৮৭ টাকা) বিএসটি (৪.২৭ টাকা) এর চেয়ে কম। ওঅ্যান্ডএম, অবচয় ও সুদসহ সেচ এ মোট ব্যয় ইউনিট প্রতি ৫.৯২ টাকা। সেচ খাতের জন্য বিইআরসি ২০১১ সালে আরইবিকে ২১০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের প্রস্তাব করে। কিন্তু সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে খুচরা মূল্য বৃদ্ধি না-ও করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন আরইবির চেয়ারম্যান। তবে এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন অনুসারে লাভ নয় লোকসান নয় নীতিতে পল্লী বিদ্যুত সমিতির গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৩.৪৮% বাড়ানো যেতে পারে। সুপারিশে বলা হয়, প্রত্যেকটি গ্রাহকশ্রেণীকে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যয়ের সাথে সামঞ্জসপূর্ণ ট্যারিফ নির্ধারণের লক্ষ্যে কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিধান মোতাবেক গ্রাহকশ্রেণীভিত্তিক পৃথক পৃথক খরচ নিরূপণের জন্য বিআরইবিকে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। বিইআরসির প্রবিধানমালা ২০০৬-এর বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত হারে কমিশনকে সিস্টেম অপারেশন ফি প্রদানের জন্য বিআরইবিকে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) তাদের সেচ গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের মূল্য ৬২.৭৫% বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। সেচ গ্রাহকের সংখ্যার দিক থেকে বিআরইবির পরেই পিডিবি’র অবস্থান। তাদের বর্তমান সেচ গ্রাহক সংখ্যা ৪০ হাজার ১৯৫- যা দেশের মোট সেচ গ্রাহকের ১২.০৬%। এ পিডিবি ও বিআরইবির প্রস্তাবিত খুচরা মূল্য বাস্তবায়িত হলে বিপাকে পড়বেন কৃষকরা।
শুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান এ আর খান জানান, তারা দেশবাসীকে টেনশনে রাখতে চান না। খুব শিগগিরই আদেশ দিতে চান। এ আর খান বলেন, বিগত সময়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সময় বলা হয়েছিলো ২০১৪ সালে এর দাম কমবে। আমি সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, এখন না হলেও ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম কমবে। মোবাইলফোনের কল রেটের উদাহরণ দিয়ে সাবেক এ সচিব বলেন, আগে মোবাইলফোনের কল রেট বেশি ছিলো কিন্তু এখন তা অনেক কম।
এদিকে গণশুনানি চলাকালে বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবিতে বিইআরসি ভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে গণসংহতি অন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাসহ কয়েকটি বাম দলের নেতাকর্মীরা।