গত শতাব্দীর তিরিশ দশক পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিশ হাজারের অধিক জাতের ধান চাষ করা হতো। কিন্তু কালের আবর্তে এ সকল দেশি জাতের ধানের বেশির ভাগই বিলুপ্ত হয়েছে। হাতেগোনা যে ক’টির নাম এখনও শোনা যায় তাও প্রায় বিলুপ্তির পথে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব, উত্পাদন স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে কৃষকগণ দেশি জাতের ধান আবাদে আর উত্সাহ পাচ্ছে না। নদীমাতৃক ও কৃষিপ্রধান আবহমান বাংলার মাঠে এক সময় শোভা পেতো কাটারিভোগ, সীতাভোগ, নলাডোক, লোতরমোটাসহ বিচিত্র নামের বিভিন্ন জাতের ধান। দেশ ও বিদেশের বিশেষজ্ঞগণ এ অঞ্চলকে তাই বহুবিচিত্র ধানের আধার বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। নতুন ধান ঘরে তোলার সময় বিভিন্ন উত্সব আমেজে মেতে উঠতো বাংলার কৃষক।
ষাটের দশকে এ দেশের কৃষকগণ দেশি জাতের পরিবর্তে উচ্চফলনশীল জাতের ধানচাষ শুরু করে। উত্পাদনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষক এ ধানের আবাদে অধিক উত্সাহ বোধ করে। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধে দেশি চালের তৈরি খাবারের চেয়ে এ চালের তৈরি খাদ্যের মানে তারতম্য রয়েছে। উচ্চফলনশীল এ ধানের আবাদে সরকারও বিভিন্ন সময় নানা উত্সাহ ও সহযোগিতা দিয়েছে কৃষকদের। ওই সময় ধানচাষে কেবল অধিক ফলনের বিষয়টি বিবেচনা করা হতো। এটি পরিবেশবান্ধব কি-না তা ততোটা গুরুত্ব পায়নি।
উচ্চফলনশীল ধান বলতে প্রথম দিকে ম্যানিলাস্থ ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ধানকেই বুঝানো হতো। প্রতিষ্ঠানের নাম সংক্ষেপ করে এ ধান পরিচিতি পেয়েছিলো ইরি ধান হিসেবে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট নানা প্রজাতির উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে, যা ব্রি ধান হিসেবে পরিচিত। এখন দেশে ব্রি ধানের আবাদই বেশি হয়ে থাকে। উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করতে প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক যা প্রকৃতিতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। তাছাড়া কৃষকগণ যেখানে তিনটি ফসল উত্পাদন করতো সেখানে একটি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুটি ফসলের বেশি উত্পাদন হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ব্রি-ধানের পুষ্টিগুণ দেশি ধানের তুলনায় অনেক কম। উত্পাদন খরচ অনেকগুণ বেশি হওয়ার কারণে প্রকৃত মুনাফার পরিমাণ সামান্যই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্পাদন ব্যয় যোগাতে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। কোনো কারণে উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে দেশি জাতের ধান আমাদের প্রকৃতির সাথে মানানসই। এর উত্পাদন ব্যয়ও সামান্য, এটি চাষাবাদে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। গত কয়েক দশকে এ দেশের পরিবেশ প্রকৃতির যে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে তাতে দেশি জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ ও উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এ ধানের মৌলিকত্ব বজায় রেখে উত্পাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে গবেষণার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি। তবে এ ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা সহিষ্ণুতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
লক্ষ্যযোগ্য যে, মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। সেই জন্য ধানের পাশাপাশি অন্যান্য শস্য যেমন- গম, যব, আলু, পেঁয়াজ, সরিষার মতো রবিশস্যের উত্পাদনে মনোযোগ দিতে হবে। আশার কথা এই যে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় হারিয়ে যাওয়া ধানের বিভিন্নজাত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। সার্বিক গবেষণা কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের সমন্বয় সাধনেরও প্রয়োজন রয়েছে। দেশি ধানের বীজের উত্পাদন ক্ষমতা বাড়লে কৃষক যেমন এই ধানচাষে উত্সাহিত বোধ করবেন, তেমনি আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্যও তা হবে সুফলদায়ী।