জঙ্গি ছিনতাইয়ের নেপথ্যে টাকা লেনদেন

 

স্টাফ রিপোর্টার: দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশের কয়েক সদস্য ও কারাগারের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে। তারা আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে সামান্য উৎকোচের বিনিময়ে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করে। এ সুযোগ নিয়ে আটক জঙ্গিরা পুরো পরিকল্পনা করে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে প্রিজনভ্যানে জেএমবির তিন জঙ্গি বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করে তাদের অবস্থান সহকর্মীদের নিশ্চিত করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকার একটু আগেই তিন জঙ্গি প্রিজনভ্যানে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে নাশতা খাওয়ার বায়না ধরে। এর পর তারা প্রিজনভ্যান থামিয়ে তাদের নাশতা খাওয়ানোর অনুরোধ করে। উত্তরে প্রিজনভ্যানে থাকা তিন পুলিশ সদস্য এ সুযোগ করে দেয়ার বিনিময়ে নগদ টাকা দাবি করেন। জঙ্গিরা জানায়, তাদের টাকা দেয়া হবে। এরপর প্রিজনভ্যান থেকেই পুলিশের মোবাইলফোনে কথা বলে জঙ্গিরা। তাদের অবস্থান সম্পর্কে কমান্ডোদের নিশ্চিত করে। এ ঘটনার কিছু সময় পর হঠাত দুটি প্রাইভেট কার ও একটি ট্রাকে জেএমবির সদস্যরা প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এসব তথ্য আরও যাচাই-বাছাই করে দেখছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে জঙ্গিদের হাতে টাকার উৎসের সন্ধানে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গিরা কোনো উৎস থেকে টাকা পেয়ে ২০ লাখ টাকায় দুটি মাইক্রোবাস ও বেশ কয়েকটি নাইন এমএম পিস্তল কিনেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রের প্রাথমিক ধারণা, দেশি-বিদেশি গোপন উৎস থেকে জেএমবিসহ দেশের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনকে তহবিল দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো গোষ্ঠী ফের জঙ্গিদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশের তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে, কারাগারে থেকে জঙ্গিরা মোবাইলফোন ব্যবহার করেছে। জঙ্গিদের ব্যবহৃত তিনটি মোবাইলফোন পরীক্ষা করে জানা গেছে অনেক তথ্য। এর মধ্যে হাফেজ জাকারিয়া নামের এক জঙ্গি একটি মোবাইলফোন কারাগারে নিয়মিত ব্যবহার করতো বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছে। এ ছাড়া একই ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শন করেছে। জঙ্গি ছিনতাইয়ের সাথে কারা কর্তৃপক্ষের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর গাফিলতি ছিলো কি না, তা জানার চেষ্টা চলছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় জঙ্গিরা মোবাইলফোনে কথা বলেছে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা। মোবাইলফোন ট্র্যাক করে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন।

তবে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রাজ্জাক সেটি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কারাগারে আসামিদের কক্ষের কাছে একাধিক জ্যামার রয়েছে। কারাগারের ওইখানে অবস্থান করে মোবাইলফোনে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। কারণ, জ্যামার থাকার কারণে কারাগারে আসামিদের কক্ষের আশপাশে কখনও মোবাইলফোনে নেটওয়ার্ক থাকে না। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পুরো দায় পুলিশের।

আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই। কারণ, কোনো আসামি কারাগার থেকে পুলিশের হেফাজতে আনা-নেয়া করানো হয়। নিরাপত্তার কোনো অভাব থাকলে তারা কেন আমাদের কাছ থেকে তিন জঙ্গিকে বুঝে নিয়েছে? দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের আনা-নেয়ার নিরাপত্তায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ করে ঘটনার দু দিন আগে পুলিশের একাধিক দফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে।

তবে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএস মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান সমকালের সাথে আলাপকালে বলেন, প্রিজনভ্যান থেকে পুলিশের মোবাইলফোনে জঙ্গিদের কথা বলার সাধারণত সুযোগ নেই। তবে জঙ্গিদের কথোপকথনের তথ্য আমরা পেয়েছি। সময় হলেই আপনাদের জানাব। এখনই বলতে চাই না। তিনি আরও বলেন, প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তায় অবশ্যই পুলিশের ব্যর্থতা ছিলো। এমন দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের কেন হেলাফেলায় পাঠানো হলো, এটা আমারও বোধগম্য নয়। ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিরা মোবাইলফোন ব্যবহার করেছে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এরই মধ্যে জঙ্গিদের ব্যবহৃত তিনটি মোবাইলফোনসেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কারাগারের ভেতরে হাফেজ মাহমুদ নামের এক জঙ্গি ব্যবহার করত। বাকি দুটি মোবাইলফোন পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের। তদন্তে এরই মধ্যে জানা গেছে, বিভিন্ন জঙ্গিরা যখন আদালতে হাজিরা দিতে যায়, সেখানে দুর্ধর্ষ এ জঙ্গিদের সাথে অন্য জঙ্গিরা প্রায়ই দেখা করতো। অনেকে চিরকুট পাঠাতো। ইতোমধ্যে চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করা হতো। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি জাকারিয়া ও রাসেল এরই মধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য স্বীকার করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, যে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, তারা জেএমবির শীর্ষ নেতা। বোমা মিজানকে রাজধানীর পীরেরবাগ থেকে গ্রেফতারের সময় সে তার শিশুসন্তান ও স্ত্রীর সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হুমকি দিয়েছিলো। বোমা মিজান হুমকি দেয়, তাকে গ্রেফতার করা হলে সন্তান ও স্ত্রীসহ সব উড়িয়ে দেবে। নিজ সন্তানকে বোমার সামনে রেখে যে জঙ্গি এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে, তাকে কেন এমন ঢিলেঢালা নিরাপত্তায় আনা-নেয়া করা হলো এ প্রশ্ন আমারও।

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাটি সুপরিকল্পিত। জঙ্গিদের সহকর্মীরা একাধিকবার এলাকা রেকি করে। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক রেকি করেছিলো। বিভিন্ন সময় এসব জঙ্গিকে অন্য মামলায় কারাগারে আনা-নেয়ার সময় সহকর্মীদের সাথে তাদের আলাপ হতো। মোবাইলফোনেও মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছিনিয়ে নেয়ার সময় পুলিশ কেন জঙ্গিদের গুলি করেনি এটাও রহস্য। আর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো ইউনিটের আগে থেকে জানতে না পারাকে বড় ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বেশ কয়েকজন হাইপ্রোফাইল জঙ্গির তালিকা তৈরি করে তাদের নজরদারিতে রেখেছে। তারা অনেকেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ আরবভিত্তিক দেশগুলোতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও উচ্চশিক্ষিত। এর মধ্যে আছে ফেনী এলাকার সাইদুর রহমান সাঈদ, টঙ্গীর মুফতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, মো. সানাউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ল্যাংড়া সালাম, ময়মনসিংহের মুফতি আবদুল হাকিম, ইয়েমেনফেরত মাইনুদ্দীন শরীফ, তেহজীব করিম, রেজওয়ান শরীফ, সাবেক শিবির নেতা ও ব্লগার রাজীবের খুনের নির্দেশদাতা রানা প্রমুখ।

এদিকে এ ঘটনায় আরেক পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. আবদুল বাতেন জানান, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গাজীপুর পুলিশ লাইনের হাবিলদার মেজর আইয়ুব আলীকে সোমবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই ঘটনায় এ নিয়ে গাজীপুরের তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল কর্তৃপক্ষ। এর আগে একই অভিযোগে রোববার পুলিশ লাইনের সুবেদার আবদুল করিমকে সাময়িক বরখাস্ত ও সংরক্ষিত পুলিশ পরিদর্শক (আরআই) সাইয়েদুল করিমকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়। তবে এখনও কোনো ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রোববার সকালে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় ওই প্রিজনভ্যানে বোমা মেরে ও গুলি করে জেএমবির শূরা সদস্য রাকিবুল হাসান ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজান ওরফে জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নেয়া হয়।