হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের মহাসড়কে চলছে অবৈধ যানবাহন : বাড়ছে দুর্ঘটনা

প্রশাসনকে ম্যানেজ করার নামে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা গাড়িপ্রতি ২শ টাকা করে আদায় করছেন

ঝিনাইদহ অফিস: মহাসড়কে শ্যালোইঞ্জিনচালিত তিন চাকার যানবাহন চলাচলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন সড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। স্থানীয়ভাবে এগুলো নসিমন, করিমন, আলমসাধু ও গ্রামবাংলা নামে পরিচিত। এগুলোর রুট পারমিট ও ফিটনেস কোনোটিই নেই। অবৈধ এসব যানবাহন চলাচলের কারণে বাড়ছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, একই সাথে শ্যালোচালিত ইঞ্জিনের বিকট শব্দে প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ হচ্ছে। জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এসব অবৈধযান বন্ধের দাবিতে একাধিকবার ধর্মঘট, অবরোধ ডেকেও কোনো কাজ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দুদিন আগে প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও তা আর চোখে পড়ছে না। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করার নামে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা গাড়ি প্রতি ২শ টাকা করে আদায় করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অবৈধযানের সরকারি কোনো রেজিস্ট্রেশন না থাকায় সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি জেলা বিআরটিএ অফিস থেকে। তবে গ্যারেজমালিক ও চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিন জেলার সবকটি সড়ক-মহাসড়কে এসব অবৈধযান চলাচল করছে এবং প্রতিদিনই এর সংখ্যা বাড়ছে। শ্যালোইঞ্জিন দ্বারা নির্মিত এসব যান্ত্রিকযানের ভাড়া তুলনামূলক কম হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাশাপাশি এগুলোর মূল্যও কম হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ খুঁজে পেয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

ঝিনাইদহ জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রোকনুজ্জামান রানু জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব অবৈধযান জেলার সড়ক-মহাসড়কগুলোতে চলাচল করছে। প্রথম থেকেই এসব যানবাহনের ব্যাপারে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন সোচ্চার থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহত একটি অংশ এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ায় এখন বন্ধ করাও কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।

ঝিনাইদহ বিআরটিএ অফিসের মোটরযান পরিদর্শক বিলাশ সরকার জানান, রুট পারমিট ছাড়া যানবাহন চলাচল বেআইনি। কিন্তু অবৈধ যানবাহনের মালিকরা রুট পারমিট কিংবা গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিআরটিএ অফিসে আসেন না। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশন বিহীন যানবাহনের জন্য ৫ হাজার টাকা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানোর জন্য ৫শ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ হাইকোর্ট থেকে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধের আদেশ দেয়া হয়েছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মনিরুজ্জামান জানান, লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়ে কৃষিকাজের জন্য ট্রাক্টর আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু তা দিনরাত মালামাল পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষিকাজ ছাড়া সাধারণ পরিবহন কাজে এগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জেলা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক মাসুদ আহম্মেদ সঞ্জু বলেন, ৭০ ডেসিবল পরিমাণ শব্দ মানুষের জন্য সহনীয়। কিন্তু এসব যানবাহন ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবল শব্দ ব্যবহার করে থাকে। ফলে এসব যান মানুষের শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে। পুলিশের সাথে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে এসব যানবাহন চালানো হচ্ছে। সদর উপজেলার দোগাছি গ্রামের নসিমন চালক ফিরোজ হোসেন বলেন, নসিমন চালানো অবৈধ হলেও আমরা গরিব মানুষ। লেখাপড়া করিনি বলে চাকরি হয়নি। তাই নসিমন চালিয়ে খাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালিচরণপুর গ্রামের এক আলমসাধুচালক জানান, পুলিশকে যানবাহনপ্রতি মাসিক ২শ টাকা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। টাকা না দিলে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় গাড়ি। থানা থেকে গাড়ি ছাড়াতে পুলিশকে ২/৩ হাজার  টাকা উৎকোচ দিতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ঝিনাইদহ শহরের পুলিশ লাইনের পাশে, বিসিক শিল্পনগরীর সামনে, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে, ক্যাডেট কলেজের সামনে, সদর উপজেলার হাটগোপালপুর ও বিষয়খালী বাজারে শাদা পোশাকে নসিমন করিমন চালকদের নিকট থেকে চাঁদা তোলা হয়। চাঁদা আদায়কারীরা বলছেন, এ চাঁদার টাকা পুলিশের কনস্টেবল, এসআই এমনকি উচ্চ পর্যায়ে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পর মহাসড়ক থেকে অবৈধযান আটকের জন্য অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ জেলায় শতাধিক নসিমন ও করিমন আটক করা হয়েছে। তবে পুলিশের চাঁদা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, অবৈধযান থেকে পুলিশের চাঁদা আদায় ও ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পুলিশের কোনো কর্মকর্তা এধরনের কাজের সাথে জড়িত নয়। তবে পুলিশকে ম্যানেজ করার নামে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা চালকদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় করছে। এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে।