বায়ান্নোত্তর ৬২ বছর ; প্রাসঙ্গিক ভাবনা

রহমান মুকুল: ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীকার, আমাদের স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলনই ছিলো স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম সোপান। এ কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত। ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না, রাজনৈতিক প্রভাবও ছিলো সুদূরপ্রসারী। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বায়ান্নোত্তরকালে ব্যাপক রূপ লাভ করে। ‘৫৪’র নির্বাচন, ‘৫৬’র সংবিধান, ‘৬৬’র ছয় দফা, ‘৬৯’র গণ আন্দোলন, ‘৭০’র  নির্বাচন, ‘৭১’র মুক্তিযোদ্ধসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম ও নীতিমালায় ভাষা আন্দোলনের অবদান অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফা বলেন, ‘গোড়ার দিকে এ আন্দোলন শিক্ষিত নবগঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাত্র-তরুণদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও একে বাংলার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাংগ্রামের চৌমহনা বলা যায়।’ যে স্বাধীনতার বীজ বায়ান্নোতে রোপিত হয়েছিলো, তার ভ্রুণ আলো হওয়ায় বেড়ে ওঠার জন্য ৭ মার্চ বাইরে বের হওয়ার অবকাশ খুঁজেছিলো। এরপরও রক্তঝরা, অশ্রুঝরা দীর্ঘ ১৬ দিন পর ২৩ মার্চ বর্তমানে স্বাধীনতার একক দাবিদার। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান দিবস পালিত হয়েছিলো। তাহলে কি স্বাধীনতা ডাক হিসেবে ৭ মার্চ প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? এর অনেক আগেই মজলুম জননেতা ভাসানী তো সাফ জবাব দিয়েছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের … আসসালামু আলাইকুম।

প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব: স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিলো মূলত সময়ের দাবি। সময়েই এদেশবাসীর করণীয় নির্ধারণ করেছিলো। পক্ষান্তরে, ভাষা আন্দোলনের জন্ম হয়েছিলো ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তখন ভাষা সৈনিকদের উপেক্ষা করতে হয়েছিলো বৈরী সমাজ ও সময়ের ভ্রুকুটিকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন দেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলো, ভাষা আন্দোলনে কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণি ছাড়া তখন ভাষা আন্দোলনের মর্মার্থ কেউ অনুধাবন করতে পারতো না। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রতি ছিলো দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন, অকৃত্রিম দরদ। এহেন কষ্টার্জিত ভাষা আন্দোলনকে কোনোক্রমেই ক্ষুদ্র পরিসরে দেখার অবকাশ নেয়। অথচ এই অমর ভাষা আন্দোলন, এই অমর একুশ কি আমরা যথার্থ মর্যাদায় পালন করছি? প্রশ্ন বিদগ্ধদের নিকট, যাদের ক্রমাগত উন্নাসিকতায় আমরা ক্রমাগত সরীসৃপে পরিণত হচ্ছি।

আমাদের স্বাতন্ত্র্য, আমাদের জাতীয়তা: আমরা বাংলাদেশি বলে গর্ববোধ করি। পৃথিবীতে আরও অনেক দেশ আছে। সেসব দেশে একাধিক ভাষাও আছে। কিন্তু অন্যান্য দেশবাসী তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মতো বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়নি। এক্ষেত্রে পৃথিবীতে আমরাই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। এ কারণে আমরা বাংলাদেশিরা অন্যান্য দেশবাসী এমনকি পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষাভাষির থেকেও আলাদা। আরও একাধিক ক্ষেত্রে আমরা স্বতন্ত্র্য। আমাদের যদি বাঙালি বলতেই হয়, তাহলে আমরা বাংলাদেশি বাঙালি। যারা শুধু ভাষা দিয়ে জাতীয়তা বিচার করতে চায়, তারা চাতুর্যের আশ্রয় নেন। তাছাড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদ তো একটা সাম্প্রদায়িক চেতনাচ্ছন্ন মতবাদ। এই চরম সম্প্রদায়িক মতবাদ বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত করে সংবিধানকেই প্রকারান্তরে করা হয়েছে কলঙ্কিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ মূলত উনবিংশ শতাব্দীর উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়িক বাঙালি মতবাদেরই নামান্তর। এ মতবাদে মুসলমান, নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের কোনো স্থান নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রখ্যাত রাজনীতিক শ্রী বসন্ত চ্যাটার্জি তার ‘ইনসাইড বাংলাদেশ টুডে’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘ইংরেজদের বদান্যতায় ও আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে যে নতুন অভিজাত শ্রেণির ক্রমশ উদ্ভব হয়, তারাই বাঙালি হিসেবে পরিচিতি পাবে। এদেরকে সাধারণ কথায় ভদ্রলোক বলা হয়ে থাকে। নিচ ভারতীয় কোনো সর্বনামবাদী হিন্দু, উপজাতি বা কোনো মুসলমান অথবা নামীয় জাতির কোনো সদস্য কখনো বাঙালি বলে বিবেচিত হতে পারে না। তার সে যতো স্বাভাবিকভাবেই এই ভাষাটিতে কথা বলুকনা কেন, অথবা তার সামাজিক মর্যাদা বা শিক্ষা যা-ই হোক না কেন।’ (পৃ:১৪৫-১৫৭) উনবিংশ শতাব্দীর এ ধরনের উগ্র সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনা সংবিধানে সন্নিবেশিত করার মধ্যদিয়ে মূলত সাম্প্রদায়িকতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের ঘাড়ে। এ প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন ‘অবাক লাগছে লড়াই করে যে জাতি নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন, সেই জাতি পরে অন্যান্য জাতির (প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানসহ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও উপজাতি) অধিকার হরণ করলো। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে এই নগ্ন বর্ণবাদী সংবিধানের ওপর দাঁড়িয়ে।’ (বন ও বনের অধিবাসী পৃ:নং ৩)

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: আমাদের সহস্র বছরের ঐতিহ্য আছে। ইতিহাসে আমাদের যোদ্ধাজাতি, সাংগ্রামীজাতি সর্বপরি মহৎজাতি হিসেবে পরিচিতি আছে। আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। বাংলাদেশি সংস্কৃতি। কিন্তু তা আজ অপসংস্কৃতি গ্রাস করছে। গাঙ্গেয় বা গাঙ্গেত্রীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেঘনা-যমুনার বুক দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক মুখপাত্র রেডিও ও টেলিভিশন মুখথুবড়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ভারতীয় বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলের প্রতি মানুষ অত্যধিক আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এ চ্যানেলগুলোতে ভারতীয় সমাজ- সংস্কৃতিই উপজীব্য হিসেবে দেখানো হয়। সঙ্গত কারণেই আমাদের যুবসমাজ যৌনতা, সন্ত্রাস, দেবদাসী, পরকীয়া, পরচর্চা, কামোৎসব ও বহুঈশ্বরবাদ জাতীয় সংস্কৃতির দিকে বিপদজনকভাবে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। এমনকি বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলার আগ্রহও হারাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে তাদের স্বর্ণগর্ভ ইতিহাস। তারা বিস্মৃত হচ্ছে পূর্বসূরীর অর্ধসহস্র বছরের উপমহাদেশ শাসনের দীর্ঘ সৌকর্যময় ইতিহাস।

প্রয়োজন শেকড় সন্ধানের: বিশ্বে এখন চলছে শেকড় সন্ধানের পালা। অথচ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আজ শেকড় থেকে বিচ্যুত। শেকড়-মূলহীন মহীরুহ তাড়াতাড়ি ভূপাতিত হয়। আমাদের অবস্থাও অনুরূপ হতে চলেছে। এখনই দরকার শক্তভাবে শেকড়-মূল আন্তরিকভাবে আলিঙ্গনের। বর্তমান ও উত্তর প্রজন্মকে দেশজ করে গড়ে তুলতে এর বিকল্প নেই। এই অমর একুশে উপলক্ষে আজ সর্বাগ্রে একথা স্মরণ থাকা প্রয়োজন।

শেষ অনুরোধ: যে দেশমাতৃকার সূর্যসন্তানেরা মায়ের মর্যাদা, মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের তাজারক্ত অকাতরে ঢেলে দিতে দ্বিধা করে না, সে মায়ের কিসের এতো লজ্জা, এতো শোক? কেন তার মাথা আজও অবনত? আমাদের জাতীয় আশা, অহঙ্কার, গৌরব ও বীরত্বের প্রতীক শহীদ মিনার। যথার্থ কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের অনুরোধ … শহীদ মিনারের অবনত মাথা সমুন্নত করা হোক। দেশমাতার গর্বিত শির চির উন্নত হোক। এটাই আমাদের অমর একুশের একান্ত প্রার্থনা।