নারায়ণ ভৌমিক: কর্চ্চাডাঙ্গা লাইনপাড়ার শিশু সাথী হত্যামামলাটি দীর্ঘ ৬ বছর ধরে তদন্তাধীন। এই ক’বছরে একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে। একদফা চূড়ান্ত রিপোর্টও দেয় পুলিশ। তাতে নারাজি আবেদন পেশ করা হলে শেষ পর্যন্ত তদন্তের ভার পড়ে সিআইডির ওপর। তদন্ত চলছে। কবে নাগাদ শেষ হবে তদন্ত? জবাব নেই।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের কর্চ্চাডাঙ্গা লাইনপাড়ার বহুল আলোচিত শিশু সাথী হত্যামামলা সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে। সাথী হত্যা নেপথ্য উদঘাটনে দীর্ঘ ৬ বছরে ৫ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে হত্যা রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়ে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। বিজ্ঞ আদালতে দাখিলি তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদী নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। আদালত আরো অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডি কর্মকর্তাকে তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন। আদালতের এ আদেশ পেয়ে চুয়াডাঙ্গা সিআইডি ইন্সপেক্টর তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।
নতুন করে সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে বলে খবর পেয়ে গ্রামেরই সেই সন্দেহভাজনদের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুঁটে উঠেছে। মামলার বাদীপক্ষ এরকমই মন্তব্য করে বলেছেন, খুনিরা তদবির করতে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছে। তারা বাদীর সাথে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আপস-মীমাংসার চেষ্টাও করছে বলে সূত্র জানিয়েছে। মামলার বাদীপক্ষের দাবি, শিশু সাথীকে কারা হত্যা করেছে তা গ্রামে এখন আর গোপন নেই। তা হলে পুলিশ কেন তাদের টিকে ছুঁতে পারলো না? সিআইডিও কি জীবননগর থানার মতো চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পথে হাঁটবে নাকি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রণয়ন করে আদালতে পেশ করতে সক্ষম হবে? এসব প্রশ্নের জবাব গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে যেমন নেই, তেমনই দীর্ঘ ৬ বছরে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পেরে ভর করেছে দীর্ঘশ্বাস।
২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কর্চ্চডাঙ্গা লাইনপাড়ার সৈয়দ আলী পাটোয়ারী ওরফে সোহেলের একমাত্র মেয়ে ১ম শ্রেণির ছাত্রী সাথী (৫) বাড়ির পাশে স্কুলমাঠে ক্রিকেট খেলা দেখে সন্ধ্যায় বাড়ির পথে রওনা হয়। বাড়ি ফেরে। বাড়িতে তার দাদিকে না পেয়ে তার ছোট চাচা শামীম পাটোয়ারীর দোকানে যায়। দাদির খোঁজ করে। এরপরই নিখোঁজ হয় সে। স্বজনরা সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজাখুজি ও এলাকায় ব্যাপক মাইকিং করে। উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। ঘটনার দু দিন পর ২৪ ফ্রেরুয়ারি বাড়ির সামনে বাজদিয়া গ্রামের আবুল কালামের ভুট্টাক্ষেত থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে জীবননগর থানার তৎকালীন ওসি নুরুল আমিন সঙ্গীয় ফোর্সসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা লাশের প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্ট ও আলামত জব্দ করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে নেন। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শিশু সাথীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন শাহাপুর ক্যাম্প ইনর্চাজ এসআই দাউদ হোসেন এ র্স্পশকাতর মামলার তদন্তভার পেয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন। তদন্তকালে তিনি গ্রামের সন্দেহভজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারকৃতদের অর্থবাণিজ্যের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে।
তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আলোচিত হয়ে ওঠায় তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার। জীবননগর থানার এসআই ইলিয়াস হোসেন তদন্তভার গ্রহণ করেন।
সূত্র জানায়, প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের অপকর্ম ঢাকতে নথিপত্রে প্রকৃত খুনিদের আড়াল করেন। তিনি নথিপত্র হাতে পেয়ে নতুন করে হত্যার ক্লু উদঘাটন করতে গিয়ে ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়ে পড়েন। বদলিজনিত কারণে এ হত্যার রহস্য উদঘাটন কিছু সময় ঝিমিয়ে পড়ে। পরে মামলাটি আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শেষে জীবননগর থানার তৎকালীন এসআই লিয়াকত আলী দীর্ঘ তদন্ত ও অনুসন্ধান চালিয়ে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেফতার করেন। এ সময় অনেকে গ্রেফতার এড়াতে গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপন করে।
সূত্রমতে এ সময় হত্যার মোটিভ সর্ম্পকে তৎকালীন ওসি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে নীরব হয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তারা তৎকালীন পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ এবং চাপের মুখে তদন্তে বিব্রত ও অসহায় হয়ে পড়েন বলে জনশ্রুতি ওঠে। পুলিশ কর্মকর্তার খবরদারি ও নজরদারির কারণে ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয় বলে অভিযোগ।
বাজদিয়া গ্রামের কৃষক নাহার আলীর ছেলে আশরাফুল ইসলামকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে অন্যদের ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করা হলে গ্রামে বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, পুলিশ সবই পারে। কার ধরার কথা কার ধরলো! বলেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন অনেকে। শেষ পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আদালতে এ হত্যামামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বিশেষ নির্দেশে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন ও পেশ করা হয় বলেও গুঞ্জন ওঠে। শিশু সাথী হত্যার রহস্য ধামাচাপা পড়ে।
জানা গেছে, সিআইডি তদন্তে ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য উদঘাটন হয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে পূর্ব বিরোধসহ ৯ বছর আগে উপজেলার বাঁকা ইউনিয়নের পুরন্দপুর গ্রামের আতিয়ার রহমানের শিশুকন্যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে পুকুরে ফেলার বিষয়টি। শিশু আফরোজাকে তুলে নিয়ে হত্যা করে পুকুরে ফেলার বিষয়টি অবশ্য সে সময় মামলা পর্যন্ত গড়ায়নি।