তেলেঙ্গানা নিয়ে হুলস্থূল কাণ্ড : ১৮ এমপি সাসপেন্ড
মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভারতে লোকসভার অধিবেশনে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের বিলকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি, পেপার স্প্রে তথা মরিচের গুঁড়ো নিক্ষেপ, কক্ষের চেয়ার টেবিল, কম্পিউটার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আর এই চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার পেশ হলো তেলেঙ্গানা বিল। এমনকি এক সংসদ সদস্য পকেট থেকে ছুরিও বের করেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এই দিনটিকে মনে করা হচ্ছে কালো দিন হিসেবে। তাত্ক্ষণিকভাবে ১৮ জন সদস্যকে বহিষ্কার করেন লোকসভার স্পিকার। নজিরবিহীন এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলই। আর এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন ভারতে সফররত বাংলাদেশের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও।
গতকাল দুপুর ১২টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে অন্ধ্রপ্রদেশ ভাগ করে তেলেঙ্গানা বিল পেশ করার আগেই মেঝেতে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিলের বিরোধী বেশ কিছু সংসদ সদস্য যারা কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে বিল কেড়ে নেয়ারও চেষ্টা করা হয়। বিলের বিরোধিতায় সোচ্চার হন বহিষ্কৃত সংসদ সদস্য এল রাজাগোপাল। তিনি গোলমরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দেন। চোখে ও মুখে সেই গুঁড়ো লাগায় শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন তার কাছে অবস্থান করা অন্য সংসদ সদস্যরা। রাজাগোপাল গ্লাসও ভাঙচুর করেন। এসময় অন্যরা কম্পিউটার ও মাইক ছুঁড়ে মারেন। সংসদ সদস্যরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় দ্রুত ডাক্তার ডাকা হয়। পরে অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেই সময় পকেট থেকে ছুরি বের করেন তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) সংসদ সদস্য বেণুগোপাল। যদিও তিনি অস্বীকার করেছেন। এজন্য তিনি ক্ষমাও চাইবেন বলেও জানা গেছে। তিনি বলেন, আমি তো কেবল পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়া সংসদ সদস্যদের থামাতে গিয়ে আহত হন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। আহত তিন সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাজাগোপালকে আটক করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গোলমালের আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেলেঙ্গানা বিল লোকসভায় উত্থাপন করেছেন। কিন্তু বিরোধীদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এ বক্তব্যকে ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান সরকারের লোকসভার শেষ অধিবেশন শুরু হওয়ার পর প্রতিদিনই তেলেঙ্গানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হচ্ছে। বুধবার গোলমালের পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, আমার হূদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সরকার অনেক আগে থেকেই এ বিল উত্থপানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু বৃহস্পতিবার যে হবে সেই বিষয়ে আগে থেকে ধারণা করা যায়নি। এদিন হঠাত্ করেই এ বিলটি উত্থাপন করা হয়। বিজেপি বলে আসছিলো, তারা এ বিলে সমর্থন দিবে। তবে সরকারকে নিয়ম অনুযায়ী অধিবেশন চালাতে হবে।
সরকার আগে থেকেই জানতো যে, বিল উত্থাপনের সময় তেলেঙ্গানা বিরোধীরা সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য পার্লামেন্টের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কারণ সীমান্ধ্রের সংসদ সদস্য সাব্বাম হারি আগেই হুমকি দিয়েছিলেন, এ বিল পাস করা হলে তিনি শরীরে আগুন ধরিয়ে দেবেন। সরকার তাই পার্লামেন্ট ভবন চত্বরে চারটি অ্যাম্বুলেন্স আগে থেকেই ঠিক করে রাখে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং গাদাগাদা কম্বলও মজুদ করা হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের ভেতরেই এ ধরনের নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সেই বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যদের প্রবেশের সময় তল্লাশি করা হয় না।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। অনেক দল আবার এজন্য সরকারকে দায়ী করেছে। ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সংসদ বিষয়কমন্ত্রী কমলনাথ। ঘটনাটিকে গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন স্পিকার মীরা কুমারও। দফায় দফায় গোলমাল ও সভা মুলতবির পর শেষ পর্যন্ত স্পিকার কংগ্রেস, তেলুগু দেশম এবং ওয়াই এস আর কংগ্রেসের মোট ১৮ জন এমপিকে সাসপেন্ড করেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠক এ ঘটনায় করণীয় নিয়ে। বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা যশবন্ত সিং এ ঘটনাকে অসম্মানজনক, নজিরবিহীন এবং ক্ষমার অযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ রাজীব ধাওয়ান বলেন, মহিলারা আত্মরক্ষার্থে মরিচের গুঁড়ো ব্যবহার করেন, সংসদ সদস্যদের ব্যবহারের কথা নয়। বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং এ ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেন, এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এটা দেখার পর মনে খুব ব্যথা পেয়েছি। ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে এধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি বলেন, এটা পার্লামেন্টের জন্য অসম্মানজনক। সরকারের উচিত ছিলো এ বিল ভোটে পাস করানো। তেলমন্ত্রী বিরাপ্পা মইলি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সৃষ্টি করা হয়েছে। স্পিকারের উচিত এর সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেয়া। এছাড়া বিজেপির সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া, তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই কংগ্রেসকে দায়ী করছে।
প্রত্যক্ষ করলেন শিরীন শারমিন: হট্টগোলের মধ্যেই লোকসভার কার্যক্রম দেখেন বাংলাদেশের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি লোকসভার অধিবেশন দেখতে যান। সকাল ১১টায় তিনি পার্লামেন্টে প্রবেশ করলে সব সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত জানান লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার। বাংলাদেশ-ভারতের একই ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে মীরা কুমার বলেন, লোকসভা এবং আমার ব্যক্তিগত তরফে বাংলাদেশের পার্লামেন্টের স্পিকারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। আমার আত্মবিশ্বাস, শিরীর শারমিনের এ সফর দু দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করবে।
এরপর তেলেঙ্গানা ইস্যুতে অধিবেশন আগের দিনের মতোই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তুমুল উত্তেজনার মধ্যে অধিবেশন মূলতবি করেন স্পিকার। এরপর আবার অধিবেশন শুরু হলেও শিরীন শারমিনকে দেখা যায়নি। বুধবার নয়াদিল্লি পৌঁছানোর পর মীরা কুমারের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার।