স্টাফ রিপোর্টার: যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির একেএম ইউসুফ (৮৭) কারা হেফাজতে মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন)। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। লাশের ময়নাতদন্তের পর সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক জানান, ইউসুফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিলো। সাধারণত স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে। ময়নাতদন্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ইউসুফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী ১৩টি অভিযোগে বিচার চলছিলো। কারান্তরীণ একেএম ইউসুফ হৃদরোগ ও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। গতকাল সকালে কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বিএসএমএমইউতে নেয়া হয়। এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী জানান, সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়েন একেএম ইউসুফ। এরপর তাকে বিএসএমএমইউ’তে ভর্তি করা হয়। সেখানে ভর্তি করার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। গ্রেফতার হওয়ার পর ইউসুফ প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। পরে তাকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার জানান, সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার সময় ইউসুফ কারারক্ষীদের সাথে কথা বলেছেন। এ সময় তিনি তার আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে বলেন। ডিআইজি জানান, সকাল আটটার দিকে একেএম ইউসুফ কাশিমপুর কারাগারে বমি করলে চিকিত্সকের পরামর্শে তাকে বিএসএমএমইউ’তে নিয়ে আসা হয়। এদিকে ইউসুফকে যথাযথ চিকিত্সা দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে তার পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ও স্বজনরা। অ্যাড. তাজুল ইসলাম বলেন, একেএম ইউসুফকে সকাল সোয়া ১০টার দিকে বিএসএমএমইউ’তে নিয়ে আসে জেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে পর্যাপ্ত প্রাথমিক চিকিত্সা দেয়া হয়নি। একই অভিযোগ তোলেন তার জামাতা ডা. আব্দুল ওহাব। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আবদুল মজিদ ভূঁইয়া বলেন, সকাল ১১টার দিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ইউসুফকে হাসপাতালে আনা হয়। তাকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তাররা সবধরনের চেষ্টা করেছেন। হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে নেয়ার সময় তার মৃত্যু হয়। ধারণা করা হচ্ছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। পরে কারাবিধি অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের আদেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালমর্গে একেএম ইউসুফের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। গতকাল সন্ধ্যায় ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিক্যালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক একেএম শফিউজ্জামান বলেন, তার (ইউসুফ) মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিলো, সাধারণত স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এমনটা হয়। কারাবন্দী এ জামায়াত নেতার দেহের ভেতরে-বাইরে কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন ছিলো না বলে জানান তিনি। পরবর্তীতে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মৃতদেহ থেকে নমুনা রেখে দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
এর আগে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তরের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। তবে ট্রাইব্যুনাল-২ এ আবেদন খারিজ করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেন। এ আবেদনের ওপর শুনানি করেন গাজী এইচএম তামিম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর হায়দার আলী। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়, একেএম ইউসুফ গ্রেফতার হওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিলেন। কী কারণে তার মৃত্যু হলো তা ট্রাইব্যুনালেরও জানা প্রয়োজন। আদালতের এ নির্দেশের পর গতকাল বিকেল পৌঁনে ৫টায় ইউসুফের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তার মরদেহ ধানমণ্ডি ১০ এ তার নিজের বাড়িতে নেয়া হয়। সেখানে রাতে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বলে তার আইনজীবী জানান।
ইউসুফের পরিচিতি: একেএম ইউসুফ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য ও একাত্তরে মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব, পূর্ত, বিদ্যুত ও সেচমন্ত্রী ছিলেন। ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, অভিযুক্ত ইউসুফের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। তার পিতার নাম আজিম উদ্দিন হাওলাদার। ছাত্রজীবনে তিনি জমিয়তে তলাবা-ই-আরাবিয়ার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি জামায়াতে যোগ দেন এবং ১৯৫৭ সালে খুলনা বিভাগীয় জামায়াতের প্রধান হন। ১৯৬২ সালে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের ডেপুটি আমির ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ অনুসারে একেএম ইউসুফ একাত্তরে বৃহত্তর খুলনার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং খুলনার মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। একাত্তরে ৯৬ জন জামায়াত সদস্য ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে খুলনার আনসার ও ভিডিপি ক্যাম্পে তিনি সর্বপ্রথম সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউসুফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে ছিলো। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার থেকে তার বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিলো। গত বছরের ১ আগস্ট ইউসুফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৩টি অভিযোগ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যার সাতটি, হত্যার পাঁচটি ও নিপীড়নের একটি অভিযোগ ছিলো।