চাঁদার টাকা না পেয়ে অস্ত্রধারী চাঁদাবাজচক্রের নৃশংসতা : ভাটা শ্রমিককে গুলি করে খুন

চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার কুমারীর মুসা হকের ইটভাটায় মধ্যরাতে দীর্ঘ সময় ধরে নৃশংসতা : পিটুনি ও গুলি  

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: চাঁদার টাকা না পেয়ে আলমডাঙ্গার কুমারী গ্রামের একটি ইটভাটায় তাণ্ডব চালিয়েছে একদল অস্ত্রধারী চাঁদাবাজ। গতপরশু রাতে হামলা চালিয়ে গুলি করে এক শ্রমিককে খুন করেছে। গুলি করে ও কুপিয়ে আহত করেছে ৫ জনকে। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

‘নিষেধ করার পরও কেন ইটভাটায় আগুন দিয়েছিস? কই তোদের মালিক কই, সব খুন করে ফেলবো।’ গতপরশু মধ্যরাতে ১৫/১৭ জনের একদল অস্ত্রধারী আলমডাঙ্গার কুমারীর এনআরবি ইটভাটায় হানা দিয়ে এসব কথা বলে আর নৃশংসতা চালায়। এক পর্যায়ে গুলি করে খুন করে ভাটার ফায়ারম্যান সুজন মৃধাকে। তিনি পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর শাহাপুর গ্রামের মৃত মালেক মৃধার ছেলে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ইটভাটার ট্রাক্টরচালক আব্দুল লতিফ। তিনি দর্শনা পরানপুরের দলুর ছেলে। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। এছাড়াও হামলাকারীদের হাতে আহত হয়েছে আরো ৪ জন। এদেরকেও বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের নিকটবর্তী কুমারী গ্রামের গাংপাড়ায় অবস্থিত মুসা হকের এনআরবি ইটভাটা। গতপরশু বুধবার রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী এ ইটভাটায় হামলা চালায়। তারা শ্রমিকদের ওপর চড়াও হয়। হামলার শিকার শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ইটভাটায় হামলার সাথে সাথে তারা গালাগালি শুরু করে। ‘এই হারামির বাচ্চারা নিষেধ করা সত্ত্বেও কেন ভাটায় আগুন দিয়েছিস। এরপর পরই গণহারে ভাটার সকল শ্রমিককে বেদম পেটাতে শুরু করে। এসময় তারা পাবনা জেলার ইশ্বরদী থানার শাহাপুর গ্রামের মৃত মালেক মৃধার ছেলে ইটভাটার ফায়ারম্যান সুজন মৃধা (৩৫), তার চাচাতো ভাই একই গ্রামের মইজ উদ্দীনের ছেলে রবিউল ইসলাম (৩২), সুজনের চাচা একই গ্রামের মৃত রহমত আলীর ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), শাহাপুরের মজের মণ্ডলের ছেলে রবি (৩৫), কুমারী গ্রামের সোহরব হোসেনের ছেলে গোলাপ আলী, দর্শনার পরানপুরের দলুর ছেলে ভাটার ট্রাক্টর ড্রাইভার আব্দুল লতিফ ও মিরপুর উপজেলার পাগলা মালিহাদের সিদ্দিককে (৫৫) বেদম পিটিয়ে আহত করে। লাঠিপেটার এক পর্যায়ে কয়েকজন শ্রমিক বলে ওঠেন- ‘চাঁদা দেবে মালিক। আমরা গরিব মানুষ। কাজ না করলে খাবো কী? ‘এ কথা শোনার সাথে সাথে এক সন্ত্রাসী প্রথমে ট্রাক্টর ড্রাইভার আব্দুল লতিফকে গুলি করে। মাথার একপাশে সে গুলিবিদ্ধ হয়। দৌড়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হলে আরেকটি গুলি করা হয়। দ্বিতীয় গুলিটি তার হাতে লাগে। এরপরও আব্দুল লতিফ থামেনি। তিনি পালিয়ে কুমারী গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। লতিফকে গুলি করার সময় পাশে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুজন মৃধা। এরপর সুজন মৃধাকেও গুলি করা হয়। নিকট থেকে তাকে গুলি করা হলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকরা বলেছেন, সন্ত্রাসীরা ভাটার ফায়ারম্যান সুজন মৃধার বুকে নল ঠেকিয়ে গুলি করে। সাথে সাথে ছটফট করতে করতে মারা যান সুজন মৃধা। স্থান ত্যাগ করে হামলকারীরা। রাতেই এ হৃদয়বিদারক কাহিনি গ্রামে জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশ সংবাদ পেয়ে ভোর রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ভোরেই লাশ উদ্ধার করে থানায় নেয় পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে লাশ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে নেয়া হয়। দুপুরে সম্পন্ন করা হয় ময়নাতদন্ত। সন্ধ্যায় নিহতের চাচা বাবুল হোসেন লাশ নিয়ে বাড়ি পাবনা ঈশ্বরদীর উদ্দেশে রওনা হন। এদিকে গুলিবিদ্ধ আব্দুল লতিফকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ভোরেই মাইক্রোযোগে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর রটে তিনিও মারা গেছেন। পরে অবশ্য জানা যায়, তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত তার শরীর থেকে ২টি গুলিই অপসারণ করা হয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত নন। অন্যান্য আহতরা কুমারী গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান করে গোপনে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন বলে জানা গেছে।

নিহতের পরিচয়: পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার শাহাপুর গ্রামের মৃত মালেক মৃধার ছেলে সুজন মৃধা হতদরিদ্র। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি আলমডাঙ্গায় আসেন ইটভাটায় কাজ করতে। বর্তমানে তিনি মুসা হকের ইটভাটায় ফায়ারম্যান হিসেবে কাজ করতেন। তিনি বিবাহিত। মাত্র ১ মাস আগে তার একমাত্র কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। নাম রেখেছেন সুবর্ণা।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য: গত ৮ জানুয়ারি রাতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) নেতা রাজু পরিচয় দিয়ে আলমডাঙ্গার বেশির ভাগ ইটভাটায় চাঁদা দাবি করা হয়। সে সময় ফরিদপুরের চান্দালী ও সেলিম, বণ্ডবিলের ঠাণ্ডু মিয়ার ও বাবু মুন্সির ইটভাটায় মোট ১৯ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় পরদিন সংবাদও প্রকাশিত হয়। একই সাথে মুসা হকের ইটভাটায়ও ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। পরদিন ফরিদপুর গ্রাম থেকে এক চাঁদাবাজকে ভাটার পাহারাদারেরা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশের নিকট সে সময় আটক চাঁদাবাজ এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলো বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে পুলিশ আর কোনো চাঁদাবাজ ধরতে পারেনি। কিন্তু ভাটা মালিক বিষয়টি গোপন করে যান। সে সময়ে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেয়া পর্যন্ত ভাটায় আগুন দিতে শ্রমিকদের নিষেধ করে। ভাটা মালিকের আশ্বাসে ও কাজের তাগিদে শ্রমিকেরা আবারও কাজ শুরু করেন। এরই এক পর্যায়ে গত বুধবার রাতে এ নৃশংস ঘটনা ঘটানো হলো। স্থানীয়রা এসব তথ্য জানিয়ে বলেছে, এলাকার চাঁদাবাজ গ্যাংগ্রুপ দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশ তাদের টিকে ছুতে পারছে না।

পুলিশের ভাষ্য: কুষ্টিয়া মিরপুর থানার একটি চরমপন্থি দল এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এছাড়া স্থানীয় চরমপন্থি একটি গ্রুপ এ ঘটনায় সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আলমডাঙ্গা থানা অফিসার ইনচার্জ। তিনি বলেছেন, ঘটনায় জড়িতদের ধরতে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। শিগগিরই জড়িতদের গ্রেফতার করা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।