ব্যাংক কর্মীর সাথে প্রেমসম্পর্ক গড়েছিলো সোহেল

স্টাফ রিপোর্টার: দুঃসাহসী ও অভিনব এ ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা হয় প্রায় আড়াই বছর আগে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে খোঁজা হয় যুঁতসই একটি বাসা। সেলিম নামে স্থানীয় ব্যবসায়ী এক যুবকের সহায়তায় তেমন একটি বাসা পেয়েও যায় সোহেল। মাত্র আড়াই হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় সে ভাড়াটিয়া হয়ে ওঠে ভল্টের সবচেয়ে কম দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত প্রয়াত ভাষাসৈনিক আমিনুল হকের টিনশেড বাসার একটি ইউনিটে। শহরের রথখোলা এলাকার সোনালী ব্যাংক ভবনের পূর্ব পাশের মাত্র ৫ ফুট গলির পরেই বাসাটির অবস্থান। সে ভাড়া বাসার ভেতর থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়েই সরানো হয় ব্যাংকের ভল্টে রাখা ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার রাতে লুট করা এ টাকা ভাড়া বাসায় আনার পর শনিবার ভোর রাতে দুটি মাইক্রোবাসে করে কিশোরগঞ্জ ছাড়ে সোহেল। এর আগে একটি ট্রাকে করে অন্যত্র সরানো হয় বাসায় ব্যবহৃত তার খাট ও আসবাবপত্র। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এরকম তথ্য জানা গেছে। তবে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার মূল হোতা হাবিবুর রহমান সোহেল ৱ্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া গ্রেফতারকৃত সোহেলের কিশোরগঞ্জের জীবন নিয়েও পাওয়া গেছে রোমাঞ্চকর তথ্য। ব্যাংক লুটের ঘটনায় জড়িত বাস্তবের এ খলনায়ক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে দু তরুণীকে। এদের একজন সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় কর্মরত কর্মকর্তা ইয়াসমিন সুলতানা (২৩)। তার সাথে প্রায় দু বছর ধরে সোহেলের প্রেমসম্পর্ক রয়েছে বলে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণী স্বীকার করেছে। হোসেনপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও চাকরির সুবাদে শহরের ভাড়া বাসায় একাকী ওই তরুণী বসবাস করতেন। অন্যজন স্থানীয় সরকারি গুরুদয়াল কলেজের তৃতীয়বর্ষের ছাত্রী সাবিনা আক্তার (২০)। তার বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানায়। ঘটনার পর পরই পুলিশ বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারী স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিমের স্ত্রী নার্গিস আক্তারকে আটক করে। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোহেলের কথিত এই দু প্রেমিকাকেও আটক করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ব্যাংক কর্মকর্তা প্রেমিকা ইয়াসমিন সুলতানার সাথে পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে সে ওই শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা/কর্মচারীর সাথে সখ্য গড়ে তুলে। পরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদেরকেও কাজে লাগায়। সেরকমই একজন ব্যাংকের এমএলএসএস আবুবকর (৪০)। তাকে আটকের পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়, ঘটনার দিন পর্যন্ত সোহেলের সাথে এমএলএসএস আবুবকরের নিবিড় যোগাযোগ ছিলো। সোহেলের পূর্ব পরিচিত এসব সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সোহেলের ব্যবহৃত অন্তত ৩০টি মোবাইল নম্বর তদন্ত সংশ্লিষ্টদের হাতে আসে। মোবাইলফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে সোহেলের ভাড়া বাসার বর্তমান মালিক পুলিশের হাতে আটক মিনা আক্তারের সাথে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বেশ কয়েক দফা ফোনালাপ হওয়ার বিষয়টিও ধরা পড়ে। সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তির দেয়া নানা তথ্য ও ফোন নম্বরের সূত্র ধরে ঘটনা জানার পর থেকেই বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিযান পরিচালনা করে।

সোহেলের কথিত দু প্রেমিকার মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা ইয়াসমিন সুলতানার বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দু বছর আগে সোহেলের সাথে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে দুজনের মধ্যে প্রেমসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর সুবাদে ইয়াসমিন সুলতানা মাঝে মধ্যেই সোহেলের ব্যাংক সংলগ্ন ভাড়া বাসায় যেতেন। এ ছাড়া তার সাথে দেখা করার জন্য সোহেলও প্রায়ই ব্যাংকে যাতায়াত করতো। ইয়াসমিন সুলতানার দাবি, সোহেলের পিতার নাম সিরাজুল ইসলাম এবং তার পিতা সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন- এমনটাই জানেন তিনি। এছাড়া শহরে তাদের বাসা রয়েছে- এমনটা জানলেও সেখানে কোন দিন যাননি।

অন্যদিকে অপর প্রেমিকা সাবিনার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কর্মকর্তা জানান, দুজনের মধ্যে প্রেমসম্পর্ক থাকার সুবাদে ওই কলেজছাত্রী মাঝে মধ্যে সোহেলের ভাড়া বাসায় যেতেন। এক সঙ্গে সময় কাটাতেন। তিনিও তার পিতার নাম সিরাজুল ইসলাম বলেই জানতেন বলে জানান। অন্যদিকে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে একই বাসাবাড়ির ৩নং ইউনিটের ভাড়াটিয়া মার্জিয়া আক্তার চায়না জানিয়েছিলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে সোহেল বাসার ওই রুমটি ভাড়া নিলেও অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিলো না। সে একাকী ওই রুমে বসবাস করতো। তার পিতা ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের কোনো এক শাখায় চাকরি করেন। তার বাড়ি হোসেনপুরের চরপুমদি এলাকায় বলে তিনি শুনেছিলেন। এ ছাড়া বাসায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে সে সোনালী ব্যাংক গলির দিকের লোহার গেট পেরোনো দরজা ব্যবহার করতো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংক গলির লোহার গেট দিয়ে ঢুকতেই যে কক্ষটি পড়ে সেটির দেয়াল থেকে টিনের চাল পর্যন্ত উপরাংশের কিছুটা জায়গা ফাঁকা ছিলো। প্রতিবেশীরা জানান, সোহেল ঘর ভাড়া নেয়ার পর গেট ও দেয়ালের উপরাংশের ফাঁকা জায়গায় আলাদা টিন লাগিয়ে সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলো। ফলে ব্যাংকের দোতলা বা বাইরে থেকে ভেতরের কোন কিছু দেখা যেতো না। তাদের মতে, সুড়ঙ্গ তৈরির পরিকল্পনা থেকেই সে ওই ফাঁকা স্থান টিন দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলো। এছাড়া তারা আরও জানান, কিছুদিন আগে থেকে ওই বাসায় রাতে করাত দিয়ে কাজ করার মতো শব্দ শোনা যেতো। এ ব্যাপারে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সে রাতে বাসায় ফার্নিচার তৈরির কাজ করে বলে জানাতো।