এমআর বাবু/নারায়ণ ভৌমিক: গত বছর ২ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল অবরোধ চলাকালে ঢাকা-মানিকগঞ্জ মহাসড়কের মানিকগঞ্জের তরা ব্রিজের ওপর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তচক্রের ছুঁড়ে মারা পেট্রোলবোমায় নিহত জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের পিকআপচালক আনিসুজ্জামান (৩৮) ও অনন্তপুর দাসপাড়ার হেলপার মহিদুল ইসলামের (৩৪) পরিবার দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। চরম অভাব অনটনে চলছে এ দু ট্রাকশ্রমিকের পরিবার। প্রায় দু মাস অতিবাহিত হলেও কেউই খোঁজ নেননি অসহায় এ দু পরিবারের। নিহতদের অসহায় বিধবা স্ত্রী ও এতিম অবুঝ শিশুরা কেমন আছে? কীভাবে চলছে সংসার? তা দেখতে সরেজমিনে দু ট্রাকশ্রমিকের বাড়িতে যান এ প্রতিবেদকদ্বয়।
উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে পিকআপচালক আনিসুজ্জামান ওরফে আনিসের বাড়িতে ইটের দেয়াল ওপরে টিনের ছাউনি দেয়া ঘরে ছিলো তার সাজানো সংসার। দেখা মেলে বিধবা স্ত্রী ও পিতৃহারা ৩ ছেলে-মেয়ের। আনিসের স্ত্রী মাজেদা খাতুন (২৮) তুলে ধরেন সংসারের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ও নানা অভাব অনটনসহ ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা। মাজেদা খাতুন জানান, মুত্যর পর খেয়ে না খেয়ে আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া চাল-ডাল নিয়ে চলছে তার সংসার। যে মানুষটি জীবিত থাকতে কতো না চেনা-জানা মানুষ খোঁজখবর নিতো, বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো; কিন্তু এখন কেউই আসে না। কেউ নেই না আগের মতো খোঁজ-খবর। সহায় সম্পদহীন নিহত আনিসুজ্জামান ওরফে আনিসের বড় মেয়ে মাসুরা খাতুন (১৪) আন্দুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, ছোট মেয়ে মিতা খাতুন (১১) ডুমুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী ও ছেলে সজীব হোসেন একই বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণির ছাত্র। পিতাকে হারিয়ে অর্থাভাবে ৩ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
একই ইউনিয়নের অনন্তপুর দাসপড়ার মৃত নোমান আলীর ছেলে পিকআপ হেলপার নিহত মহিদুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে শোকার্ত পরিবারের মাঝে এখনও চলছে প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা-বেদনা ও শোকের ছায়া। সামনে মাটির দোয়াল পেছনে জরাজীর্ণ ভাঙাচুরা চাটাইয়ের বেড়া দেয়া। ওপরে টিনের ছাউনির ঘর মহিদুলের। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে পরিবারের সদস্য নিহত মহিদুল ইসলামের বিধবা স্ত্রী দু সন্তানের জননী তাসলিমা খাতুন (২৪) বলেন, বাড়ি থেকে ভোরে বের হওয়ার সময় বলে গেলো কাল আসবো। পরদিন বাড়ি এলো ঠিকই তবে লাশ হয়ে। ছোটবেলায় বাপ-মাকে হারিয়েছি। সংসার জীবনে পা দিয়ে সুখেই ছিলাম। কিন্তু স্বামীকে হারিয়ে আজ আমি দিশেহারা। সহায় সম্পদহীন হেলপার মহিদুল ইসলামের মৃত্যুর পর গ্রামের লোকজনের দেয়া চাল-ডাল ও নগদ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে চলছে তাসলিমার সংসার। বড় মেয়ে পুষ্পিতা বয়স সাড়ে ৩ বছর ও মারিয়া ৪ মাস। অবুঝ দু মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে অসহায় তাসলিমা এখন অথৈই সাগরে পড়েছেন। নিহত মহিদুল ইসলামের মা বিধবা রিজিয়া খাতুন (৬৫) শিশু সন্তান পুষ্পিতাকে কোলে নিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেন, অভাব-অনটনই ছিলো সংসারে নিত্যসঙ্গী। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ৩ ছেলে ৩ মেয়েকে নিয়ে ছিলো সুখের স্বপ্ন। বেটাকে হারিয়ে সেই সুখ আমার কপালে আর সইলো না। মাত্র ৪ শতক জমির ওপর ৩ ছেলের বসবাস। এরই মাঝে চলছে ৩ ছেলের নিত্যসঙ্গী অভাব-অনাটনের সংসার।
উল্যেখ্য, আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের নুরু মণ্ডলের ছেলে পিকআপচালক আনিসুজ্জামান ও অনন্তপুর দাসপাড়ার মৃত নোমান আলীর ছেলে হেলপার মহিদুল ইসলাম গত বছরের ২ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের ডাকে হরতাল-অবরোধ চলাকালে উপজেলার উথলী ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের ময়না সরকারের পিকআপ নিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসসডাঙ্গা থেকে কপিভর্তি করে ঢাকার কাওরান বাজার যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ তরা ব্রিজের সন্নিকটে পৌঁছুলে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদল গাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারে। এ ঘটনায় চালক আনিসুজ্জামান গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে মহাসড়কের ওপর আছড়ে পড়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পরিবহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। অপরদিকে হেলপার মহিদুল ইসলাম গাড়ির মধ্যেই মারা যান। খবর পেয়ে রাতে মানিকগঞ্জ টহল পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিহতদের লাশ উদ্ধার করে এবং ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে।