স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাননি, অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি নির্বাচিতও হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত নিয়েছেন শপথও। তিনি কে? অন্য কেউ নন, তিনিই সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। নতুন সরকার গঠনের পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিযুক্ত করে মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
এ পদ পেয়ে তিনি জানালেন, আমি খুশি হয়েছি। তবে যেহেতু দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলাম, তাই মন্ত্রীর মর্যাদা আমার জন্য বেমানান। অতএব, এ দায়িত্ব আমি নিচ্ছি না। কিন্তু এখানেও দৃশ্যত তার ইচ্ছার পরাজয়। হঠাৎ দেখা গেলো, গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে আদালতে গেলেন তিনি। তাই সর্বত্র প্রশ্ন জাগলো তার পদমর্যাদা নিয়ে। তারপর নিজেই জানালেন, মন্ত্রীর মর্যাদায় বিশেষ দূতের পদটি তিনি গ্রহণ করেছেন। এভাবেই একের পর এক অসহায় আত্মসমর্পণ চলছে এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের। এমনকি নিজ ঘরেই এখন নিদারুণভাবে পরবাসী তিনি। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পদে পদে যেমন তার ইচ্ছার পরাজয় ঘটছে, তেমনি ন্যূনতম গুরুত্ব নেই অর্ধশতাব্দীকালের জীবন সঙ্গিনীর কাছেও। সব মিলিয়ে পড়ন্ত বেলায় ভাগ্য বিপর্যয়ের চূড়ান্ত ধাপে তিনি। নিজের দুর্ভাগ্যের সূতোয় বেঁধে নিয়েছেন আপন ভাইকেও। সে কারণে দু ভাইয়ের এখন দুঃখের কোনো সীমা নেই।
ওয়াকিবহালরা জানান, বিরোধী দলের বর্জনের মুখে একতরফা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে কোনো চালাকি ছিলো না। দু ভাই মিলেই সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করেন। যতো চাপই আসুক, নির্বাচনের বাইরে থাকবে তাদের দল। অথচ ছোট ভাই বরাবরই ছিলেন এখনকার ক্ষমতাসীনদের কাছের মানুষ। নিজের দলকে এ পক্ষে রাখতে সব সময়ই বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এ জন্য দলের বড় অংশের কাছে অনেক নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। তবুও ওদিকেই টেনেছেন সব সময়। কিন্তু পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা তার মধুর নয়। বরং নানা রকম তিক্ততায় পূর্ণ ছিলো। আর সে কারণেই চিন্তায় পরিবর্তন। স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তনটা পছন্দ হয়নি পুরনো বন্ধুদের। সুতরাং শুরু হয় নতুন গেম প্ল্যানের বাস্তবায়ন পর্ব। মেধাবী ছোট ভাইয়ের সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর বিশেষ আস্থা ছিলো বড় ভাইয়ের। আর সে কারণেই নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ক্রমশ দৃশ্যপটে টানছিলেন তাকে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আগের মন্ত্রিসভায় সুযোগ করে দেন তাকে। এ নিয়ে দলের কয়েক নেতা পুড়ছিলো হিংসায়। টানা পাঁচ বছর ধরে তারা জ্বলতে থাকেন বিরামহীন ঈর্ষার আগুনে। তাতে নতুন করে ঘি পড়ে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে। তারা দুজনই চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হন সাবেক ফার্স্ট লেডির কাছে। বিশেষ আন্তরিকতার সাথে জানালেন, ম্যাডাম আমরা তো চাই স্যারের পর আপনিই হবেন দলের প্রধান। কিন্তু ঘটনা চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। স্যার ঠিক করে ফেলেছেন তার উত্তরসূরি। নিজের ভাইকেই তিনি বসাবেন ওখানে। তারপর যা ঘটলো, তা হার মানায় বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনীকেও। রীতিমতো জ্বলে উঠলেন সাবেক ফার্স্ট লেডি। বললেন, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না। কৌশল ঠিক করার নির্দেশ দিলেন ওই দু নেতাকে। কৌশল আগেই ঠিক করা ছিলো। কেবল সেটা জানালেন ম্যাডামকে। তিনি তো এক কথায়ই রাজি। তারপর শুরু হলো বাস্তবায়নের পর্ব। দলের চেয়ারম্যান হিসেবে সকল প্রার্থীকে নির্দেশ দিলেন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে। তাতে সাড়া দেন বেশির ভাগ প্রার্থী। মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন করেন নেতা এবং তার ছোট ভাই। কিন্তু এবার গোল বাধায় স্বয়ং নির্বাচন কমিশন। নানা ছুঁতায় গ্রহণ করা হয়নি বেশ কয়েকটি মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন। নেতা ও তার ভাইয়ের আবেদনও অগ্রাহ্য করা হয়। সুতরাং ইচ্ছার বাইরেই তারা রয়ে যান নির্বাচনে। এভাবে নতুন এক নজির সৃষ্টি করে নির্বাচন কমিশন।
এরই মধ্যে ঘটলো অন্য ঘটনা। রাতের আঁধারে হঠাৎ করেই নেতাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। কাছের লোকজন কিংবা ভাইবোন কেউই জানলো না তার অসুস্থতার কথা। জানলো কেবল রাষ্ট্র। আর তাই সবকিছু হলো শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায়। নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা নাটকীয়তার পুরোটা সময় তিনি সেখানেই ছিলেন। অবশ্য এটা ছিলো তার পুরনো ঠিকানা। সে কারণে সাধারণ নেতাকর্মীদের দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ ছিলো না। এই সুযোগে তার নামে আসতে শুরু করলো নানা কিসিমের বক্তব্য। এক উপদেষ্টা সংবাদ ব্রিফিং করে জানালেন, নেতা স্বেচ্ছায় হাসপাতালে যাননি। তাকে সেখানে আটক রাখা হয়েছে। নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি অটল আছেন। একই কথা জানালেন নেতার ছোট ভাইও। বললেন, আমরা নির্বাচনে নেই। আমাদেরকে জোর করে নির্বাচনে রাখার চেষ্টা চলছে। এসব কথার বিপরীতে কিছুটা রাখঢাকের কৌশল গ্রহণ করে সাবেক ফার্স্টলেডির পক্ষ। মিডিয়াকে আড়ালে রেখেই নির্বাচনের সব রকম প্রস্তুতি চলে এ পক্ষে। এভাবেই চলে আসে নির্বাচনের দিন। নজিরবিহীন বর্জনের মধ্যে সারাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ভোট। সেই ভোটে জিতে যান ফার্স্ট লেডির অনুসারী প্রায় সকলে। কৌশলগত কারণে জিতিয়ে আনা হয় নেতাকেও। শুধু পরিকল্পনামাফিক হারিয়ে দেয়া হয় সাবেক ফার্স্ট লেডির দেবরকে। তবে হেরে গিয়েও তিনি জিতে যান অন্যভাবে। সেদিনের নির্বাচনে সারাদেশে মোট ৪৩টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এর মধ্যে ২৭টি কেন্দ্র ছিলো তার নির্বাচনী এলাকায়। কিন্তু এ জেতায় কোনো ফল নেই। ষড়যন্ত্রের পুরো অংশ যখন বুঝতে পারেন, ততক্ষণে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসলেন দু ভাই। নতুন কিছু কৌশলও ঠিক করলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পাউয়ার পলিটিকসের ঝানু প্লেয়ার হিসেবে পরিচিত এ নেতা কঠিন প্রতিশোধের শিকার হলেন অর্ধশতাব্দীরও অধিককালের সঙ্গিনীর কাছ থেকে। দলের ভেতরে-বাইরে তার কোনো কথাই এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। সংরক্ষিত আসনে এমপি পদে নিজের পছন্দের কাউকেই জায়গা দিতে পারেননি তিনি। এমনকি ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যকেন্দ্রে থাকা আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকেও নয়। অগত্যা ভীতি-হতাশার অন্ধকারেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঁচতে চাইছেন মামলার জালে বন্দি এ রাজনীতিক। আর সবকিছু থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে আপাতত দেশের বাইরে গেছেন তার ছোট ভাই।