আবারও বড় আকারে ওষুধের দাম বাড়াতে যাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো

স্টাফ রিপোর্টার: আবারও বড় আকারে ওষুধের দাম বাড়াতে যাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো। পাইকারি বাজারের তথ্যমতে, গত এক থেকে দেড়মাসের মধ্যে দাম বেড়েছে দু শতাধিক ব্র্যান্ডের। বরাবরের মতো দাম সমন্বয়ের অজুহাত দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সারাদেশে চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধ জোগান দেয় এমন শীর্ষ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। দাম বৃদ্ধির তালিকায় জ্বর-সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধও আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২শ ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়া সাধারণ ঘটনা নয়। এটি ইঙ্গিত দেয় আবারও ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে।

ওষুধের দাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মূল্য নির্ধারণ কমিটি আছে। স্বাস্থ্যসচিব এ কমিটির সভাপতি। মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, গত ৩০ জুন মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছিলো। ওই বৈঠকে অন্ততপক্ষে আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন স্বাস্থ্যসচিব। কয়েকটি কোম্পানি তাতে কর্ণপাত না করে গত ২০ অক্টোবর একসঙ্গে বর্ধিত মূল্যের তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকা পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতেও ধরিয়ে দিয়েছে তারা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বলেন, গত কিছুদিনে কয়েকটি কোম্পানি ভ্যাট দেয়ার নিমিত্তে বর্ধিত দাম সম্পর্কে অধিদফতরকে জানিয়ে ফাইল অনুমোদন করিয়ে নেয়। আসলে দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে জানলেও কিছু করার নেই। কারণ ১৯৯৪ সালে জারিকৃত এক অফিস আদেশ কোম্পানিগুলোকে দাম নির্ধারণের সুযোগ করে দিয়েছে।’

২০১২ সালের মাঝামাঝি কোম্পানিগুলো অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে প্রায় ১ হাজার ২শ ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়েছিলো। বড় কোম্পানির অনুসরণে অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানিগুলোও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে তা অনুমোদন করিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৫-৩০টি কোম্পানির প্রতিনিধিকে বৈঠকে তলব করে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন।

পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বাজারের তথ্যমতে, এবার দাম বৃদ্ধির শীর্ষে আছে স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপটা, এসিআই, একমিসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির ওষুধ। হিসাব কষে দেখা গেছে, বৃদ্ধির হার ২০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। দুয়েকটি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। অবশ্য বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি (বাপি) বলছে, ওষুধের দাম বাড়ানোর ঘটনা স্বাভাবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। নেতাদের দাবি, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর তুলনায় ওষুধের দাম খুব বেশি বাড়েনি। বাপি মহাসচিব আবদুল মোকতাদির বলেন, বাজারে একই ধরনের ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করা হয়। ২শ ব্র্যান্ডের দাম বেড়ে থাকতে পারে। তবে জেনেরিক বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি মোটেই বেশি নয়।

বৃদ্ধির তালিকায় জ্বরের ওষুধ: বেক্সিমকো কোম্পানির নাপা এক্সট্রা (প্যারাসিটামল+ক্যাফেইন) ওষুধটি জ্বর-সর্দি-মাথাব্যথা নিরাময়ে একটি জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ওষুধ। এ আইটেমে ২০০টি ট্যাবলেটের দাম আগে ছিলো ৫০০ টাকা। এখন তা ৬০০ টাকা করা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। এই আইটেমে দাম বাড়ানোর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি বাপি।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, শুধু প্যারাসিটামল জেনেরিক সরকারের তালিকাভুক্ত ১১৭টি এসেনশিয়াল ড্রাগসের মধ্যে পড়ে। ক্যাফেইনযুক্ত হওয়ায় নাপা এক্সট্রার দাম নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার কোম্পানির হাতে চলে গেছে। স্কয়ার ফার্মা উৎপাদিত প্যারাসিটামল+ক্যাফেইনযুক্ত এইচপ্লাস ৫০০ মিলিগ্রামের ২০০টি ট্যাবলেটের পাইকারি মূল্য ছিল ৩৮৪ টাকা। এখন তা ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

মরসুমি রোগের ওষুধেও বাড়তি খরচের বোঝা: শীত মরসুম এলে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত ওষুধের চাহিদা বাড়ে। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদিত শ্বাসকষ্টের ওষুধ কর্টান ২০ মিলিগ্রামের ৫০টি ট্যাবলেটের খুচরা মূল্য ছিলো ১৮৬ টাকা। এখন তা ৩১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৬৮ শতাংশ। একইভাবে ১০ মিলিগ্রামের ২০৭ টাকা মূল্যের ১০০টি ট্যাবলেট এখন ৩২৩ টাকা এবং ৫ মিলিগ্রামের ২৩০ টাকার ২০০টি ট্যাবলেটের দাম বাড়িয়ে ৩৪৪ টাকা করা হয়েছে।
শ্বাসকষ্ট সমস্যা নিরাময়ে একমি ল্যাবরেটরিজ কোম্পানি উৎপাদিত ৪৫ টাকার সালমোলিন ট্যাবলেট এখন ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৭৭ শতাংশ। প্রোফেন সিরাপ আগে বিক্রি হতো ১৮ টাকায়। এখন ৩৩ টাকা করা হয়েছে। এখানে বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। সূত্রগুলোর ধারণা, শীত মৌসুম সামনেই। মুনাফা বাড়াতে সময় বেছে নিয়েছে কোম্পানিগুলো। উদাহরণ আরও আছে। বেক্সিমকো উৎপাদিত ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ডায়ারিল-১, ২ ও ৩ ট্যাবলেটের দাম এক মাস আগেও ছিল যথাক্রমে ৩, ৫ ও ৭ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৫০ পয়সা, ৮ ও ১০ টাকা। এই কোম্পানির এক হাজার মিলিলিটার কলোরাইড স্যালাইনের দাম ছিল ৬৮ টাকা। বর্তমানে তা করা হয়েছে ৯১ টাকা ৭২ পয়সা। ৬৩ টাকার ডেক্সোরাইড ১০০ টাকা ৮৯ পয়সা, ৬২ টাকার ডেক্সাকোয়া ৯১ টাকা এবং ভেক্সাকোয়া ডিএস ৭২ টাকা থেকে ১০০ টাকা ৪৮ পয়সায় উন্নীত করা হয়েছে।
পিছিয়ে নেই স্কয়ার : প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বলছে, বহুল জনপ্রিয় কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে মোটেও পিছিয়ে নেই। এবারে এই কোম্পানির ৪০০ মিলির ১০০ অ্যামোডিস ট্যাবলেটের দাম ২০২ থেকে বাড়িয়ে ২৭৭ টাকা করা হয়েছে। একই কোম্পানির ৫০০ মিলিগ্রামের ৩০টি লিব্যাক ট্যাবলেটের দাম ৩৭৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৫০ টাকা, ৫০০ মিলিগ্রামের ৩০টি সিপ্রোসিন ট্যাবলেট ৩৬০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ ও জিম্যাক্স ৫০০ মিলিগ্রামের ৩০টি ট্যাবলেট ৩৬০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪২০ টাকা। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ওয়াশের জন্য ব্যবহৃত ২৫ টাকার ভায়োডিন মাউথওয়াশের দাম ৩০ ও ৩৮ টাকারটি ৬০ টাকা করা হয়েছে। ২০১২ সালে গ্যাস্ট্রিকের সিরাপ এন্টাসিড ৩২ টাকা থেকে এক লাফে ৬৫ টাকা করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বৈঠকে খেদোক্তি করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ওষুধ বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যরা। বহুমুখী সমালোচনার মুখে অবশ্য সিরাপের দাম পরে ১০ টাকা কমিয়েছে স্কয়ার।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য-১ শাখা থেকে একটি অফিস আদেশ জারি হয়েছিল। এ আদেশটি সরকারকে ওষুধের দাম নির্ধারণে ক্ষমতাহীন করে ফেলেছে। জনস্বাস্থ্য-১ শাখা থেকে জারি হওয়া আদেশে বলা হয়, তালিকাবহির্ভূত ঔষধসমূহের নির্দেশক মূল্য স্ব স্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করিবে। ফলে বিগত ১৯ বছর ধরে কোম্পানিগুলো যে দাম চাইছে অধিদফতর সেই দামই অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। অধিদফতরের মহাপরিচালকের ভাষায়, দিতে বাধ্য হচ্ছি। অবশ্য তিনি বলেন, কোনো আইটেমের দাম অযৌক্তিক মনে হলে তিনি কমানোর জন্য যতোদূর সম্ভব দরকষাকষি করেন।

বাপি মহাসচিব আবদুল মোকতাদির বলছেন, কয়েকটি ওষুধের দাম বাড়লেই সেটা নিয়ে হইচই বেশি হয়। আসলে সামগ্রিকভাবে দাম বাড়ছে না- দাবি তার। এদিকে ওষুধের দোকান (ফার্মেসি) ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি (বিসিডিএস) বলছে, এক বছরের মধ্যেই একাধিকবার দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সমিতির ডেপুটি সেক্রেটারি এএসএম মনির হোসেন বলেন, এভাবে কিছুদিন পরপর ওষুধের দাম বাড়িয়ে মানুষের ওপর খরচের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দরিদ্র মানুষ। অথচ প্রতিদিন সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্নবানে জর্জরিত হচ্ছেন বিক্রেতারা।