স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয়ার কার্যক্রম স্থগিত করেছে সরকার। এছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত তিন বছরে এবং চাকরির শেষ সময়ে এসে যেসব সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আজকালের মধ্যে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক গতকাল রোববার বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের কাছে প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এ ছাড়া পত্রপত্রিকায়ও বিষয়টি এসেছে। আমরা নিজেরাও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। তাই আমরা সনদ দেওয়া স্থগিত করেছি। তিনি বলেন, গত তিন বছরে যারা সনদ নিয়েছেন এবং যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাদের সনদের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রথমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ বাতিল করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকলে তা ফেরত নেয়া হবে। এরপর সনদ দিতে নতুন নীতিমালা করা হবে। পরে প্রয়োজন মনে করলে আবেদন যাচাই-বাছাই করে আবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয়া হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তায় মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রীকে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে কর্মকর্তাদের মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভুয়া সনদ নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।
সূত্র আরও জানায়, মন্ত্রণালয় একজন নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করবে। গত তিন বছরে যত সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, ওই কমিটি তা যাচাই-বাছাই করবে। এতে যাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তাদের সনদ বাতিলের পাশাপাশি সনদের কারণে পাওয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ফেরত নেয়াসহ সরকারি গেজেট বাতিল করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও অবসরে গেলে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তা স্থানীয় পর্যায়ে খতিয়ে দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য যারা সুপারিশ করেছিলেন, প্রয়োজনে তাদের সাথেও কথা বলা হবে। এসব কাজ শেষ করার পরই একটি নীতিমালা করা হবে এবং ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন করা হবে।
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যেসব ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে বা যাঁদের সনদ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাচাই করে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম গতকাল বলেন, যদি কারও বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার অভিযোগ ওঠে তবে অবশ্যই তার সনদ বাতিল করা উচিত। আমি দায়িত্ব পালনকালে আগের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করেছি। এখনো যাদের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, তাদের সনদ বাতিল করা উচিত।
কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, একদিকে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত অনেকে ভুয়া সনদ দেখিয়ে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে নিয়েছেন, অন্যদিকে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে অমুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-পুতিরা সরকারের বিভিন্ন স্তরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত চাকরিতে ঢুকছেন। এরা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য বরাদ্দ করা বিশেষ সুবিধা অবৈধভাবে ভোগ করছেন।
প্রসঙ্গত, মহাজোট সরকার ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করে। এর আগে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। সূত্র জানায়, অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারী তাদের সনদ প্রত্যয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার সনদে গলদ পাওয়ায় মন্ত্রণালয় সেগুলো প্রত্যয়ন করেনি। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে এক হাজার ৬৬৮ জনের সনদে গলদ ধরা পড়ে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে জানিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। তবে ভুয়া সনদধারী কারও বিরুদ্ধে এখনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।