তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম দফা সম্পন্ন
স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় ঐক্য, উন্নতি, শান্তি-সমৃদ্ধি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংহতি ও কল্যাণসহ বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সুখ-শান্তি ও অগ্রগতির জন্য মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ৪৯তম বিশ্ব ইজতেমার ১ম পর্ব গতকাল রোববার শেষ হয়েছে।
বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দু হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ অনুগ্রহ কামনা করা হয়। মোনাজাতে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচ সকল ভেদাভেদ ভুলে একই কাতারে শামিল হয়ে সবাই চোখের পানিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণে ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
বেলা ১২-৫৫ মিনিটে শুরু করে ১-১৬ মিনিট পর্যন্ত ২১ মিনিটের এ মোনাজাত চলাকালে সমগ্র ইজতেমাস্থল ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা আমিন! আমিন!! ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সর্বত্র এক পুণ্যময় পরিবেশ বিরাজ করে। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাত পরিচালনা করে আসছেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি দিল্লির হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। এবারও তিনি প্রথম পর্বের ইজতেমার তাত্পর্যপূর্ণ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন।
এ বছর অনুকূল আবহাওয়া বিদ্যমান থাকায় ১ম পর্বের আখেরি মোনাজাতে দেশ-বিদেশের আনুমানিক ৪০ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ইজতেমা আয়োজকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন। আগামী ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। শেষ হবে ২ ফেব্রুয়ারি।
আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল রোববার ভোর থেকে লাখ লাখ মুসল্লি পায়ে হেঁটেই ইজতেমাস্থলের দিকে পৌঁছেন। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ আশুলিয়া, কামাড়পাড়া সড়ক, ঢাকা-কালীগঞ্জ সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। অনেকেই খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন। পার্শ্ববর্তী বাসা-বাড়ি, কল-কারখানা-অফিস ও দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় অবস্থান নেন। যেদিকেই চোখ যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষের কাফেলা। ইজতেমাস্থলের চারপাশে ৫ থেকে ৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। আখেরি মোনাজাতের জন্য গতকাল আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিলো ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিলো না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন। এছাড়া ইজতেমা মাঠে না এসেও টেলিভিশন ও মোবাইলফোনের মাধ্যমে সারাদেশের কোটি কোটি মানুষ মোনাজাতে শরিক হন।
গণভবন থেকে মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় তার সাথে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ইজতেমা ময়দানে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে বসে মোনাজাতে অংশ নেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক এমপি, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং পার্টির মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার এমপি ইজতেমা মাঠে মঞ্চের কাছে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাতে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ শরিক হন। পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দল-মত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন এটলাস বাংলাদেশ লিমিটেডের ছাদে বিশেষভাবে নির্মিত প্যান্ডেলে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। তিনি ১২-২০ মিনিটে প্যান্ডেলে এসে উপস্থিত হয়ে বয়ান শোনেন। তাকে স্বাগত জানান গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এমএ মান্নান। উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান, সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসানউদ্দিন সরকার, খায়রুল কবির খোকন, শিরীন সুলতানা, হেলেন জেরিন খান, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহান শাহ্ আলম, কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
মুসল্লিদের দুর্ভোগ: এ বছর ইজতেমা মাঠের বাইরে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের অভাবে বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ বয়ান শুনতে এবং মোনাজাতে শামিল হতে ভোগান্তিতে পড়েন। ইজতেমা ময়দানের প্যান্ডেলের বাইরে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা না নেয়ায় অনেক মুসল্লি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইজতেমা মাঠে মহিলাদের কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও মোনাজাতে শরিক হতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মহিলা টঙ্গীর আশপাশে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অবস্থান নিয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকে নদীর পাড়ে বা আশপাশে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেন। অজু, গোসল, খাওয়া-দাওয়াসহ ভোগান্তির শেষ ছিল না তাদের।
আখেরাতের জিন্দেগি দীর্ঘস্থায়ী: গতকাল রোববার বাদ ফজর বাংলাদেশের মাওলানা জামিরউদ্দিন মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান করেন। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত ভারতের হযরত মাওলানা সা’দ তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে হেদায়তি বয়ান করেন। বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশ তাবলিগ মজলিসে শুরার সদস্য কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা জোবায়ের।
মাওলানা সা’দ বয়ানে বলেন, দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতের প্রতি আমাদের বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে। দুনিয়ার জিন্দেগির চেয়ে আখেরাতের জিন্দেগি দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো পেরেশানি ধেয়ে আসছে। এ পেরেশানি থেকে রক্ষার জন্য আমাদের ঈমানি শক্তিকে আরো মজবুত করতে হবে। ধাবিত হতে হবে আখেরাতের দীর্ঘ জিন্দেগির দিকে। আল্লাহর কাছে কৃতকর্মেরর অনুশোচনার মাধ্যমে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চোখের পানি ফেলে মোনাজাত করতে হবে। মোনাজাত কবুল হলে আমরা পাপমুক্ত হব। দুনিয়া ও আখেরাতে ফিরে আসবে শান্তি।
হযরত মাওলানা যোবায়েরুল হাসান বয়ানে বলেন, দ্বীনের ঘরে বসে ইবাদতের চেয়ে বাইরে মেহনত করে ইবাদত-বন্দেগি করাতে অনেক বেশি ফজিলত। আল্লাহ তার বান্দাদের দ্বীনের কাজে রাস্তায় বের হতে হুকুম দিয়েছেন। সকলকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য বলেছেন। আর এ দাওয়াতের জন্য তালিম নিতে হবে। মহল্লায় মহল্লায় মসজিদে বসে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। এতে শক্রও বন্ধু হয়ে যেতে পারে। যিনি এখলাছের সাথে দ্বীনের কাজ করবেন তিনিই কামিয়াব হবেন। আল্লাহকে খুশি করার জন্য কাজ করলে জীবনে সফলতা আসে। সবচে বড় আমল হলো দ্বীনের কাজে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া। দুনিয়ার ধন-সম্পদ আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। আখিরাতে দুনিয়ার কোন সম্পদ কাজে লাগবে না, শুধু দ্বীন ও আমলই কাজে লাগবে।
বিদেশি মেহমান ৩৫ হাজার: এবারের বিশ্ব ইজতেমায় এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কমপক্ষে ১৩৫টি দেশের তাবলিগ জামাতের প্রায় ৩৫ হাজার বিদেশি মেহমান অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশি মেহমান এসেছেন।
আরো তিন মুসল্লির মৃত্যু: গত তিন দিনে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে মোট ৭ জন মারা গেছেন। গতকাল রোববার ইজতেমা ময়দানে তিনজন মুসল্লি ইন্তেকাল করেন। এরা হচ্ছেন- ছমিরউদ্দিন (৭৫)। বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার গোলাপগঞ্জ থানার লবনাবন্দ গ্রামে। ঢাকার দোহার থানার কাসেম আলী বেপারী (৬৮), পিতা জাবক্স বেপারী ও ঢাকার বংশালের ১৭১/৪-এ সিদ্দিক বাজার এলাকার সিরাজউদ্দিন (৫০), পিতার নাম তারা মিয়া।
মোনাজাত শেষে যানজট ও জনজট: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিভিন্নস্থান থেকে আগত মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন। টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট।