স্কুলছাত্র প্রান্তর অপমৃত্যু এবং কিছু প্রশ্ন

 

মেহেরপুরের স্কুলছাত্র শাঈখ হাসান প্রান্তর অপমৃত্যু অবশ্যই সচেতন অভিভাবকমহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। হত্যা নাকি আত্মঘাতী তা নিয়ে পুলিশ প্রশ্ন তুলে প্রকৃত মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। প্রান্তর পিতা হত্যার অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যে এজাহারও দাখিল করেছেন। হত্যা? কে বা কারা করলো, কেন করলো? আত্মঘাতী? তাতে প্ররোচনা করলো কে বা কারা? নাকি অতিশাসন? প্রশ্নগুলো অমূলক নয়।

ওর বয়স আর কতোই হয়েছিলো, দশম শ্রেণির ছাত্র। অতোটুকু বয়সে জীবন সম্পর্কে সে কতোটুকুই বা বুঝতে শিখেছিলো? অকালে এই ঝরে যাওয়াকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, অপ্রাপ্ত বয়সী প্রান্ত নিখোঁজ হওয়ার পর প্রেমঘটিত বিষয়টি যেমন আলোচনায় উঠে আসে, তেমনই আত্মগোপন কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। হত্যাই হোক, আর আত্মঘাতীই হোক, অপমৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া জরুরি। হত্যা হলে ঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি আইনসিদ্ধ। আর আত্মহত্যা করলে প্ররোচনাকারীকেও খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ দরকার। আর পিতা-মাতার অতিশাসনে যদি অভিমানই মৃত্যুর মূল কারণ হয়, তা থেকেও সমাজকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। সেটাও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। স্কুলছাত্র প্রান্তর মৃত্যু রহস্য যতো গভীরই হোক, তা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে উদঘাটনের সক্ষমতা পুলিশ দেখাবে বলেই বিশ্বাস।

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, সমাজে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। পারিবারিক এবং প্রতিবেশীকেন্দ্রিক সমস্যা শিশু-কিশোরেরা সৃষ্টি করলেও তা শোধরানোর সুযোগ দিতে চান না অনেকে। অথচ শিশু-কিশোরদের সৃষ্ট অধিকাংশ সমস্যাই বুঝিয়ে সমাধান করা সম্ভব। কোনো কোনো পিতা-মাতা সন্তানকে সুপথে রাখতে না পেরে অতিশাসনে দূরে ঠেলে দেন। সন্তানকে বোঝানোর চেয়ে এমন কিছু সময় আসে যখন তাকেই বোঝার চেষ্টা করতে হয় পরিবারের বড়দের। বিশেষ করে পিতা-মাতাকেই এ দায়িত্ব নিতে হয়। সন্তানের মন বুঝে বোঝানো হলে সুপথে রাখা খুবই সহজ। অথচ সে পথে না হেঁটে একতরফা উপদেশ আর কড়া শাসনে তাকে বিষিয়ে তুলি আমরা। পিতা-মাতা উভয়েই যদি সন্তানকে অতিশাসনে সুপথে রাখার চেষ্টা করেন, তা হলে সেই সন্তানের মনের কথা বলার মতো কেউ কি থাকে? একজনকে অন্তত বন্ধু হতে হয়। নির্ভরতার বন্ধু। যাকে নির্ভর করতে পারে। নির্ভরতা হারালে হতাশা গ্রাস করে। সেই হতাশা ডেকে আনতে পারে সর্বনাশ। প্রান্ত কি এরকম সর্বনাশের শিকার? নাকি মানুষরূপী হায়েনার দল খাবলে খেয়েছে তাকে?

যোগাযোগ মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যেমন বাড়িয়েছে যোগাযোগ সুবিধা, তেমনই কিছু সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। হাতে হাতে সেলফোন, ইন্টারনেট। এসব থেকে সন্তানকে সরিয়ে রাখাও যেমন মেধাবিকাশে অন্তরায়, তেমনই ওসবের মাধ্যমে বিপথগামী হওয়াও অসম্ভব নয়। সে কারণেই প্রয়োজন সেলফোন, ইন্টারনেট ব্যবহারে বাড়তি দৃষ্টি, বাড়তি সতর্কতা। যে বয়সে জীবন সম্পর্কেই স্বচ্ছ ধারণা হওয়ার কথা নয়, তখন নিজেকে নায়কের আসনে বসানোর জন্য সস্তা গল্পের আকর্ষণীয় সিনেমা নাটক যেমন দায়ী, তেমনই নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে না পারাটাও সমাজের ব্যর্থতা। কিশোরকালে উগ্রতা, ভয়ঙ্কর বিরোধে জড়িয়ে পড়াকে সামাজিক প্রবণতা বলা অতোটা যুক্তিযুক্ত নয়, যতোটা যৌক্তিক কিশোরদের ওইসব যোগাযোগ মাধ্যমে বন্দি করে ফেলা। খেলাধুলার সুযোগ নেই। পড়ো পড়ো, আর ঘরে বসে হয় টিভি দেখো না হলে ইন্টারনেট। কিশোর বয়সে মনটা কৌতূহলী হওয়াটাই স্বাভাবিক। জানতে চায়, জানার সুযোগ পেতে চায়। জানা বোঝার পথ যদি নোংরা হয় তা হলে পা পিছলে হোঁচটেরই ঝুঁকি বেশি থাকে। সমাজে যে এ ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়েছে তা বলাই বাহুল্য।

কিশোর প্রান্তকে হত্যা করা হয়েছে। এ অভিযোগকে আত্মঘাতী বলে ধামাচাপা দেয়া হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। আবার হত্যা নয়, অথচ সন্দেহের বশে কাউকে দোষারোপও সমাজের জন্য কল্যাণকর হয় না। তা আইনসিদ্ধও নয়। স্কুলছাত্র প্রান্তর অপমৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হলে সমাজ সচেতন হবে, কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হবে। অপরাধীর পার পাওয়ার খেসারত সমাজকেই দিতে হয়।