চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত : মেঘের আড়ালে সূর্য : ঝরছে যেন বরফ কণা

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় যেন বরফ পড়ছে। মেঘাচ্ছন্ন চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের বাতাসে কুয়াশা রূপ নিয়েছে ক্ষুদ্রবরফ কণায়। তবে তা বরফেরে চেয়ে বেশ উষ্ণ। পরিবেশটা মূলত পশ্চিমা শীতপ্রধান দেশগুলোর মতোই। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৭ রেকর্ড করা হলেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নেমেছে সর্বনিম্নের কাছাকাছি। আজও অভিন্ন আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল জীবননগরে শীতজনিত কারণে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে।

তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিন ঢাকা ছিলো কুয়াশার চাদরে। দেখা মেলেনি সুর্যের। উত্তরের হিমেল হাওয়ার সাথে কুয়াশা বৃষ্টিতে মানুষ যবুথবু হয়ে পড়েছে। বৈরি আবহাওয়ার কারণে রাস্তাঘাটে মানুষ তেমন একটা বের হচ্ছে না। ৪-৫ দিন পর গত মঙ্গলবার থেকে বেড়েছে পুনরায় শীতের তীব্রতা। আর শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে শিশুদের শীতজনিত শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চলতি মরসুমে  তাপমাপা যন্ত্রের পারদ সবচেয়ে নিচে নেমে আসে গত বৃহস্পতিবার। ওইদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয় ৬ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় গতকালও বিভিন্ন সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। তীব্র শীতে দুস্থ শীতার্ত শীতবস্ত্র হাতে পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি নিয়ে ফিরেছেন আপন ঠিকানায়। বিতরণকৃত শীতবস্ত্র অপ্রতুল। ফলে দানশীল ব্যক্তিদের দ্রুত শীতবস্ত্র বিতরণে আরও আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। এলাকার সচেতনমহল এরকমই মন্তব্য করে বলেছেন, তীব্র শীতে যাদের ভরসা আগুনের উষ্ণতা তাদের পাশে সহযোগিতার বস্ত্র নিয়ে না দাঁড়ানো অমানবিকতা।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ জাহেদুল ইসলাম জানান, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কম ও হিমেল হাওয়ার কারণে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। এ ধরনের আবহাওয়া বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (আজ) অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল বুধবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনে ও রাতে কনকনে হিমেল হাওয়ায় শীতের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। শীতের তীব্রতা শীতার্ত মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সাথে বেড়েছে শীতজনিত রোগবালাই। চুয়াডাঙ্গা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু রোগী শীতজনিত রোগে আক্রান্ত। ৫০ জন শিশু ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এর বাইরে ১৫০-১৭০ জন প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছে।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, গত মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫০ জন মারা গেছে। তাদের বেশিরভাগ শীতজনিত রোগে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। দরিদ্র মানুষেরা খরকুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

গতকাল চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৮৪ সালের এসএসসি ব্যাচ এলাকার দুস্থ শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন- নূরুল আমিন জোয়ার্দ্দার, মকসুদুল হক মালিক, তহিবুর রহমান জোয়ার্দ্দার, মাসুম কামাল ডাবলা, পিনা, জব্বার, সহিদুল, কবুল, টিঙ্কু, অ্যাড. সাহভীর, মামুন-অর রশিদ আঙ্গুর প্রমুখ।

সরোজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) উদ্যোগে দুস্থ শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন কার্যালয় থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। এসডিএফ সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আব্দুল্লাহ আল সামী। বিশেষ অতিথি ছিলেন সরোজগঞ্জ বাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আব্দুল্লা শেখ, সাধারণ সম্পাদক শাহাজান আলী পচা, এসডিএফ নির্বাহী পরিচালক এমএ কাশেম, বাজার কমিটির ক্যাশিয়ার শরিফুল ইসলাম, আজিজুল হক আঙ্গুর প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাজার কমিটির সদস্য জিল্লুর রহমান।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, প্রায় সপ্তাখানেক ধরে চলছে শীতের এ কনকনে দাপট। গতকাল তো সারাদিন-রাত আলমডাঙ্গায় কুয়াশাবৃষ্টি হয়েছে। বিকেলের পর এ বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কনকনে উত্তরে হাড়কাঁপানো শীতের হিমেল হাওয়া অবিরাম দাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। শীত উপেক্ষা করেই সাধ্যমতো গরম পোশাক পরে বাইরে বের হতে হচ্ছে মানুষকে। শীতে যবুথবু গরিব মানুষের কষ্টের সীমা নেই। তাদেরকে বাড়িতেই কাটাতে হচ্ছে সময়। গতকাল ডাউকি গ্রামে বেশ কয়েকজন সকল বয়সের মানুষকে আগুন পোয়াতে দেখে এগিয়ে গেলে বৃদ্ধ আসগর আলী মালিথা বলেন, ‘আইসো বাপ এট্টু হাত-পা আগুনি গরম কইরে ন্যাও। বড্ডা টালা রে বাপ! বাঁইচে থাকাই দায়!’ হতদরিদ্ররা একটা শীতবস্ত্রের জন্য যেন তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছেন। এখনো সরকারিভাবে দুস্থদের সহযোগিতা করা হয়নি। শুধু আলমডাঙ্গা পৌর মেয়র মীর মহি উদ্দীন ব্যতীত কোনো ব্যক্তি কিংবা সরকারি দলের কোনো নেতা এখনও গরিবদের সাহায্যে এগিয়ে যাননি। এমনকি এনজিওগুলোও হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগরে তীব্র শীতে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার সুটিয়া গ্রামের শওকত আলীর স্ত্রী সামেনা খাতুন (৬৫) গতকাল বুধবার দুপুরে শীতজনীত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ নিয়ে চলতি শীত মরসুমে তৃতীয় দফার শৈত্যপ্রবাহে উপজেলায় ৩ জনের মৃত্যু হলো।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালের ঘনকুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে উপজেলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র শীতের মধ্যে সীমাহীন কষ্টে পড়েছে বৃদ্ধ, শিশু, দরিদ্র ও ছিন্নমূল অসহায় মানুষ। এছাড়াও শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়ে গবাদি পশুপাখিও কাবু হয়ে পড়েছে। শীতের প্রকপে উপজেলায় মাথাব্যথা, কোল্ডডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর প্রদাহ ও সর্দি-জ্বরসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

জীবননগরে হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। জনতা ব্যাংক জীবননগর শাখার উদ্যোগে গতকাল বুধবার এ শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। ব্যাংকের জীবননগর শাখা ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল কাদির দরদ্রি মানুষের মাঝে এ শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার সুলতানুল ইসলাম, অফিসার জিয়াউর রহমান, অফিসার অঞ্জন কুমার সাহা ও অফিসার শাকিনা খাতুন প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, ঘনকুয়াশা আর উত্তরের হিমেল হাওয়ার সাথে সাথে মেহেরপুরে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীতের তীব্রতার কারণে ঠাণ্ডাজানিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। কর্মজীবী মানুষেরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। গরম কাপড়ের অভাবে নিম্ন আয়ের মানুষেরা শীত নিবারণে হিমসিম খাচ্ছে।

নতুন বছর শুরুর প্রথম থেকেই মেহেরপুরে শীত জেঁকে বসেছে। শীতের তীব্রতা এতোটা বেশি যে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের মুখ দেখা মিলছে না। গতকাল ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় আকাশ ঢাকা ছিলো। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলাচল করেছে। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, কয়েক দিন থেকে চুয়াডাঙ্গা ও পার্শ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরের তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দুপুরের আগে মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। শহর ফাঁকা থাকছে। মাঝে মাঝে চায়ের দোকানগুলো ভিড় জমে থাকতে দেখা গেছে। আবার শিশু-কিশোরদের রাস্তার ধারে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন তাপাতে দেখা দেছে। কর্মজীবী মানুষেরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা গরম কাপড়ের অভাবে চরম কষ্টের মধ্যে রাতযাপন করছে। রিকশা-ভ্যান চালকরা কাজের জন্য বাইরে বের হলেও শহরের লোকজন কম থাকায় কাজ না পেয়ে অনেকে ফিরে যাচ্ছে।

নিম্ন আয়ের মানুষেরা স্বল্প দামে শীতবস্ত্র কিনতে শহর ও গ্রামগঞ্জের ফুটপাতে ভিড় জমালেও এবার আর শীতবস্ত্র তেমনভাবে মিলছে না। হরতাল আর অবরোধের কারণে আমদানি না থাকায় চড়া দামে কিনতে হচ্ছে ফুটপাতের শীতের কাপড়। লাগাতার হরতাল-অবরোধের কারণে বাজারে পুরাতন কাপড়ের মজুদ কম রয়েছে। পুরোনো কাপড়ের মজুদ কম থাকায় কাপড়ের দাম বেশি হয়েছে। যে কারণে গরিব মানুষেরা পুরোনো কাপড় কিনতে পারছে না। পুরোনো কাপড়ের অনেক ব্যবসায়ী জানালেন, প্রতি বছর ৫/৬ হাজার টাকায় এক বেল কাপড় কিনতে পারলেও এবার দশ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে।

কালীগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে উদ্যোগে গরীব শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে বলিদাপাড়াস্থ প্রশিক্ষণ ও বিকাশকেন্দ্র আয়োজিত শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. মাহাবুবার রহমান। ইয়ুথ কালীগঞ্জ ইউনিটের সভাপতি ওমর সানির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, শাহজালাল  ইসলামী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার ম্যানেজার আহসানুল কবির, কালীগঞ্জ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন, রোকেয়া খাতুন, শাহিন হোসেন, মনির হোসেন, রাজু আহমেদ প্রমুখ।