৪ দিন ধরে বহু খোঁজাখুঁজির পর নির্মাণাধীন বাসটার্মিনালের ঘরে পাওয়া গেলো মৃতদেহ
মেহেরপুর অফিস: মেহেরপুরের নিখোঁজ স্কুলছাত্র প্রান্তকে (১৫) জীবিত পাওয়া যায়নি। বহু খোঁজাখুঁজির পর গতকাল তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার ৪ দিনের মাথায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যার দিকে মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠ মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাশে নির্মাণাধীন বাসটার্মিনালের একটি ঘরের মধ্যে থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। প্রেমের কারণে অপহরণের পর হত্যা নাকি আত্মহত্যা? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শুরু করেছে স্কুলছাত্র প্রান্তের পিতা মাতাসহ পুলিশ।
মেহেরপুর সদর থানা পুলিশ স্কুলছাত্র প্রান্তের লাশ উদ্ধারের সময় সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়ন করে। পরে লাশ নেয়া হয় মেহেরপুর থানায়। আজ মঙ্গলবার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হবে। স্থানীয়দের অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছে, প্রেমঘটিত কারণে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ স্বজনরা নিশ্চিত হতে পারছে না। নিখোঁজ হওয়ার পর অপহরণের সন্দেহও করে তার পরিবারের সদস্যরা।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নির্মাণাধীন বাসস্ট্যান্ড মাঠে এলাকার আশ্বারায়ে মোবাশ্বারায়ে প্রিক্যাডেট মাদরাসার ছাত্ররা খেলা করছিলো। ওই সময় তাদের ক্রিকেট বল বাসটার্মিনালের একটি কক্ষের মধ্যে চলে যায়। তাদের একজন বল কুড়াতে টার্মিনালের মধ্যে গেলে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার দেয়। লোকজন ছুটে এসে দেখতে পায় একটি কিশোরের নিথর দেহ ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। খবর পেয়ে মেহেরপুর পৌর মেয়র মো. মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু ও সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। স্বজনরা প্রান্তের লাশ শনাক্ত করেন। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি শেষে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে সদর থানায় নেয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি টুপি, একগোছা চাবি, এক জোড়া হাতমোজা ও তার ব্যবহৃত মোবাইলফোনটি উদ্ধার করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে মেহেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলাম বলেন, লাশের হাতে একটি চিরকুট ছিলো। তাতে লেখা ছিলো ‘আমার জান আরিফুলকে কেউ দোষ দিবা না।’ লাশের মুখে সামান্য গন্ধ ছিলো। সে নিজে আত্মহত্যার জন্য বিষ পান করেছে; না কেউ তাকে হত্যা করতে বিষ প্রয়োগ করেছে তা বলা মুশকিল। রাতের বেলায় খুব ভালো বোঝা না গেলেও তার শরীরে আঘাতে কোনো চিহ্ন আছে বলে মনে হয়নি। আগের রাতে কিংবা ভোরের দিকে সে মারা যেতে পারে বলে মনে হয়। শরীরের পোশাক ছাড়িয়ে আজ মঙ্গলবার দিনের আলোতে খতিয়ে দেখা হবে এটি হত্যা না আত্মহত্যা। নিহতের স্বজনরা কোনো ক্লু জানালে রহস্য উদঘাটন করতে পুলিশের জন্য সহজ হবে।
লাশ উদ্ধারের পর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছেন চাঁদার দাবিতে তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। আবার কেউ বলছেন, প্রেমঘটিত কারণে প্রান্তকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কেউ কেই মনে করছেন প্রেমের কারণে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ মনে করেন প্রেমের কারণে তাকে তুলে নিয়ে আটকে রাখার পর আগের রাতে খুন করে লাশ ওই স্থানে ফেলে রেখে গেছে ঘাতকরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বাসটার্মিনালের ঘরে পড়ে থানা লাশের পোশাক ভেজা ছিলো এবং তখনও তার নাক দিয়ে লালা ঝরছিলো। তবে তারা বলেছেন, দেখে মনে হয়নি ওই স্থানে তাকে কেউ খুন করেছে বা সে নিজেই ওই স্থানে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার কোনো আলামত সেখানে ছিলো না। মনে হয় পরিকল্পিতভাবে অন্য স্থান থেকে তাকে খুন করে লাশ ওই স্থানে ফেলে গেছে। লাশ দেখে মনে হয়েছে সে খুব ক্ষুধার্ত ছিলো। আটককারীরা তাকে হয়তো এ ক’দিনে খেতে দেয়নি। লাশের সাথে পাওয়া চিঠিটিতে সে তার এক বন্ধু আরিফুলকে জানের জান সম্বোধন করে লিখেছে ‘আমার জান আরিফুলকে কেউ দোষ দিবা না’।
মেহেরপুর সদর থানার এসআই কামাল জানান, প্রাথমিক দৃষ্টিতে লাশের শরীরে আঘাতে চিহ্ন দেখা যায়নি। তবে তার শরীরে কোনো ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষ প্রযোগ করে অথবা তার নিম্নাঙ্গে আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়েছে কি-না তা দিনের আলো ছাড়া বলা মুশকিল। এরপরও ময়নাতদন্ত হলে বোঝা যাবে হত্যারহস্য কী? এছাড়া কী কারণে প্রান্ত খুন হতে পারে সে কথাও তার স্বজনদের পক্ষ থেকে পুলিশকে বলা হয়নি।
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, নিখোঁজ হওয়ার আগে তার মোবাইলফোন থেকে সে নাজমুল নামের এক বন্ধুকে জানিয়েছে, ‘এ নম্বরে আমাকে আর পাবি না’। এদিকে অন্য একটি সূত্র বলেছে, সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের সহপাঠী এক বান্ধবীর সাথে প্রান্ত প্রেমসম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলো। সম্প্রতি মেয়েটির শহরের এক ধনীর দুলালের সাথে বিয়ে হয়েছে। পথের কাঁটা সরাতে প্রান্ত খুন হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। তারা আরো নিশ্চিত করেছেন- প্রান্তের লাশ উদ্ধারের পর নবদম্পতি নিখোঁজ হয়েছে।
এদিকে প্রান্তের চাচা আব্দুল্লাহ আল মামুন চপল জানান, প্রান্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো। গত বৃহস্পতিবার রাতে পাড়ার মসজিদে বন্ধু আরিফুলের সাথে সে এশার নামাজ আদায় করেছে। পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে শহরের গড় পুকুর মসজিদে যাবে বলে সে আরিফুলকে কথা দেয়। এরপর নামাজ শেষে দুজন নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওনা দেয়। ওই রাতে কে বা কারা কেন তাকে ডেকে বা তুলে নিয়ে গেছে তা তাদের জানা নেই। তিনি আরো বলেছেন, মুক্তিপণের দাবি দিয়েও তাদের পরিবারে কেউ ফোন করেনি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে। চাঁদার দাবিতে তার ভাতিজা প্রান্ত খুন হয়েছে এমন কথা তিনি মনে করেন না।
উল্লেখ্য, মেহেরপুর শহরের নতুন শেখপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেহেরপুর পৌরসভার হিসাবসহকারী জাহিদ হোসেন অরুনের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় সাঈদ হাসান প্রান্ত। প্রান্তের একমাত্র বোন প্রভা (৫)। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রান্ত এলাকার মসজিদে এশার নামাজ পড়তে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে ওই দিন মধ্যরাতে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় একটি জিডি করা হয়। প্রান্ত মেহেরপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র। তার মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজন, এলাকাবাসী ও সহপাঠীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারে চলছে শোকের মাতম।