গ্রামীণ সমাজ জীবনের বিস্তৃত পরিসরে আমরা প্রতিনিয়ত বিচিত্র ও নানান হাজারো প্রতিভার মানুষের সন্ধান পাই। যারা কাজ করে চলেছেন একান্ত নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। আত্মপ্রকাশ বা সামাজিক পরিচিতির তোয়াক্কা না করেই তারা নিজ কর্তব্যজ্ঞানে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান। আমাদের লোকজীবনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র সব উৎস বা উপাদান পরম মমতায় তারা আগলে রাখেন। নবীন কবি আব্দুল হান্নান তাদের অন্যতম। জীবনের উষালগ্নে সাহিত্যচর্চার উন্মেষ না ঘটলেও সাহিত্য সংস্পর্শে বরাবরই তিনি আপ্লুত হতেন। কর্মজীবনের শুরুতে পারিবারিক নানান প্রতিবন্ধকতা, সমাজের চারপাশের মানুষের নিস্পেষণ, হিংসা হানাহানি এবং সর্বোপরি হয়তোবা কোনো এক সুন্দরী ললনার ভালবাসাবঞ্চিত জীবনের টানাপোড়েনে তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনীবেশ করেন।
তরুণ কবি মো. আব্দুল হান্নানের জন্ম মার্চের, ১৯৬৬। মেহেরপুর জেলার ধানখোলা ইউনিয়নের সানঘাট গ্রামে। পিতা মো. আব্দুল মান্নান ও মা রওশনারা বেগম। দু ভাই ও দু বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শৈশবে সানঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কৈশোরে গাংনী মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকেই ১৯৮৪ সালে এসএসসি এবং ১৯৮৬ সালে মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও ১৯৯০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি ডিগ্রি কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি ওই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
মাটির কাছে থাকা এই কবির বাহ্য-বৈভব নিতান্ত কম না হলেও গ্রামীণ বৃত্তিজীবিকা নিয়েই তার দৈনন্দিনতা। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপন, বৃহত্তর সামাজিক পরিচয় এসবের নিরিখে নিতান্তই বিবর্ণ মনে হলেও স্বতঃস্ফূর্ত অন্য শিক্ষা সম্বল করে তিনি নিজেকে আলোকিত করেছেন। সেসবেরই কিছু হদিস পেতে গেছি গাংনীর সানঘাট গ্রামে খর-গ্রীষ্মের দুপুরে গাছপালা ঘেরা ভৈরবের পাড়ে কবির আশ্রমে। ধানজমির আল বেয়ে, তামাক ক্ষেতের পাশ কাটিয়ে, অসংখ্য মৎস্য চাষের পুকুর পাড় বেয়ে এই গ্রাম্য কবির কাছে হাজির হই মার্চের, ২০১২ তারিখে। নিতান্ত সহজ-সরল আর সাদা মাঠা মানুষটি তখন নিজ পুকুর পাড়ে পরিষ্কার অভিযানে নিরত। আমাকে দেখেই একগাল হাসি ভরা মুখ নিয়ে এগিয়ে এলেন। পুকুর পাড়ে বাঁশের চরাটে বসে কথা বলতে বলতে কবি হান্নান এক সময় প্রকৃতির বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। শোনালেন তার জীবন গাঁথা, দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ, আর ভালোবেসে লেখা কবিতার গল্প। গ্রাম তাকে প্রতিনিয়তই কাছে টানে। ঘাস-ফুল-নদী আর গ্রাম্যজীবনের অপরূপ বর্ণনা তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। কবে, কাকে, কখন, কোথায় ভালোবেসে এক সময় কবি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন কোন সুদূরে তা তার নিজের কাছেই অজানা। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটার খোঁজে কবি সদা ব্যাকুল। যার প্রতিফলন তার কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে। কবি হান্নানের কাছে জীবন একটি চলমান স্রোতধারা। জীবনের সাথে অসংখ্য স্রোতস্বিনী মিশে জীবনকে পরিপূর্ণ রূপ দেয়। যা কালচক্রে হৃদয়ের মধ্যিখানে উঁকি দেয় বারবার। এখানেই তার অতৃপ্ত ভালোবাসার করুণতম উচ্ছ্বাস জীবন দর্শনের সম্মিলনে একাকার হয়ে গেছে। তিনি চলার পথে এক পোড় খাওয়া মানুষ, এক বহুমাত্রিক বর্ণময় মানুষ, এই মানুষ পথিক মানুষ, আত্মভোলা মানুষ। অসংখ্য সাধারণ মানুষ। যিনি সহস্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লিখে চলেছেন বিরহী প্রেমের অমর বিজয়গাঁথা।
প্রতিটি মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার মাতৃভাষা ও পারিপার্শ্বিক মানুষজন তার অস্তিত্ব ও চেতনার সাথে মিশে থাকে, কেউই যে ভুলে যায় না- আব্দুল হান্নানের কবিতা সেটা আরেকবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তার কবিতায় মেহেরপুরের রূপ-রস-গন্ধ আর চেনা জগতের আলো-বাতাস যেন পাঠকের গায়ে এসে লাগে। যদিও তার কবিতার সাথে পাঠক একেবারেই প্রায় অপরিচিত। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মনের মাঝে একটি নদী’ কবি দ্যোৎনায় মূহ্যমান। কাব্যগ্রন্থটিতে তিনি জীবনে ও চারপাশে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো করে লেখনীর মাধ্যমে ঝরিয়েছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে। মাটির সোঁদা গন্ধ, বৃষ্টির অঝোর ধারা, আকাশের রংধনু, সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, কুয়াশাস্ন্যাত শুচিশুভ্র সকাল, শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি কবিকে প্রতিনিয়ত কাছে টানে। উন্মাতাল হাওয়া তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার কল্পনার বনলতা সেনের কাছে। যাকে তিনি ভালোবেসেছেন, ধিক্কার দিয়েছেন, ভুলে থাকতে চেয়েছেন আবার গভীর মমতায় কাছে টেনেছেন। জীবনের বাস্তবতা এক সময় একাকার হয়ে শব্দঝংকারে কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে কবির কাছে। কবির ভালোবাসার মানুষটি কখনো দেশ, কখনো মা, কখনো মাটি, কখনো বা মানুষ হয়ে ধরা দিয়েছে কল্পনার রং তুলিতে। ‘মনের মাঝে একটি নদী’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো ছন্দ অলংকরণে উপস্থাপিত। কবি চেষ্টা করেছেন শব্দ চয়নের মাধ্যমে মনের ক্ষুধাকে উপস্থাপিত করতে। বিশাল শব্দ ভাণ্ডার থেকে শব্দের গাঁথুনি গেঁথেছেন একজন নিপুণ কারিগর হিসেবে। তার অধিকাংশ কবিতায় বিরহ, হতাশা আর ভালোবাসার দৈনতার ছাপ সুস্পষ্ট। কবিতায় কিছু ভাষাগত ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকলেও পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কবিতা ছাড়াও লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান সংগ্রহে তার রয়েছে চরম ও পরম মমতা। মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও তাগিদ থেকে তিনি কাজ করে চলেছেন আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রহের। কথায় কথায় বললেন, ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ইতিহাসের অনেক উপাদান হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে এসব ইতিহাসের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। যতো দ্রুত নথিভূক্ত করা যায় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ততোই মঙ্গল। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এরই মধ্যে পেয়েছেন তালা গাঙচিল ৩২তম লেখক সম্মেলনে কবি সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পদক। তাছাড়া তিনি গাঙচিল সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের আজীবন সদস্য। প্রতিদিনের ছুটে চলার পথে ভালো লাগা, খারাপ লাগাকে সঞ্চয় করে কবির সামনের দিকে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয় কামনা করি।
কবি আব্দুল হান্নানের কয়েকটি কবিতাংশ পাঠকের জন্য উপস্থাপিত হলো:
অহমিকা
শরীরে তোমার মানুষের রক্ত পশুর তো নয়
ঢাঁকিয়াছো বসন আঁচল টানিয়া লক্ষী সবে কয়।
শ্যামলও শোভায় সাজিয়াছো দেবী জগৎ ভূমে
গৌরবের ভারে হারায়েছো পথ বিবর্জিত মর্মে।
মানুষকে তুমি করিয়াছো হেলা সীমাহীন সুখে
সহস্র সঞ্চয়ে সাজায়েছো ছবি হৃদয়হীন বুকে।
স্বর্গের নয়ন ভালবাসার দেবী প্রসন্ন কুঠিরে
ছলনার ছায়া পুষিয়াছো বুকে কলুষিত অন্তরে।
যে অহমিকায় করিতেছো খেলা উৎসুক নয়নে
বীর্য সিংহাসন হারাতে হবে ভূলে গেল মনে।
স্বপ্ন সম্ভার পড়ে রবে থরে থরে ধরণীর পরে
বিজলী আলোতে হারাবে একদিন ভাবো বসে গভীরে।
স্বপ্ন বাসনা দেবীর অহংকার বিলাসের মোহ
হারাবে সব পথ ভূলে গেছো আজ দেখিবে না কেহ।
তোমার ক্ষমতা সমাপ্ত হবে হে দুনিয়ার রাণী
শৌর্য-বীর্য সব পড়ে রবে এখানে অহংকার ধ্বনি।
তোমার জয়গান গাহিবে না কেহ সফল কুলধ্বনি
স্বর্ণ মদিরায় হবেনা লেখা তোমার ইতিহাস খানি।
টেনে নিয়ে যাবে ঐ সীমানার পারে রাখিবে রুদ্ধ দ্বারে
ভেবে দেখো হে দেবী আজ নির্বাক মনে নীরব আঁধারে।
মহীয়সী রাণী ক্ষণিকের দুনিয়ায় ছিলে স্বর্গ মোহে
রাজ আদেশ আসিবে যখন তুমি অতীত দেখ চেয়ে।
আমিও যাবো তুমিও যাবে দেবী পড়ে রবে দুনিয়া
খেয়ায় ভাসিবে ঐ অনন্তকাল শৃঙ্খল পরিয়া।
ভাঙনের খেলা
ভাঙনের খেলা খেলিলে শুধু
দেখিলে দূর হতে
পথহারা পথে ভাসায়ে ভেলা
চলিনু ছিন্ন আশাতে।
ফিরিতেছি পথে দূর হতে দূরে
ব্যথার গান গেয়ে
তিমির রজনী গোপন আকুলতা
নীরবে যায় বয়ে।
মগ্ন চরাচরে স্বপ্ন বাঁধা ছিল
ফুঁটেছিল শতদল
দিশেহারা পথে হারানো বেদনা
হৃদয়ে বিরহ অনল।
কত বিস্মৃত রজনী গিয়েছি ভুলে
ভুল ভাঙা স্বপনে
হাসি মুখখানি ছিল লাজে বাঁধা
মিলন চঞ্চলা মনে।
আমার হৃদয়ে স্বপ্ন বাঁধা ছিল
কোন উজানের টানে
প্রেম ভালবাসায় ঢাকা কুহেলিকা
শূণ্য পথের কোণে।
উদাসী পথ হারালো নীলিমায়
ছবিখানি ভাসে মনে
দিগন্ত সীমানায় মায়া মরীচিকা
তোমারি খুঁজি স্বপনে।
হৃদয়ে বাঁধা বেদনার পেয়ালা
স্বপ্ন আঁধারে ভরি
নিশীথ তিমিরে শুধু ছিল ছায়া
মিছে আশায় মরি।
কুসুম ফুঁটেছিল নবীন আশাতে
বাঁধনহারা হৃদয়ে
অদৃশ্য ডোরে হারালে অজানায়
ভালবাসা জাগায়ে।