স্টাফ রিপোর্টার: মেহেরপুর জেলা সদরের রাজনগর শেখপাড়া ও হিজুলী গ্রামে যৌথবাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত টানা অভিযানে ৩৭ জনকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ৫ জন নারী রয়েছেন। গতকাল বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৪ নারীসহ ২০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। বাকিদের সদর থানায় দায়েরকৃত ৬টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। অভিযানে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে।
জানা গেছে, অভিযানের শুরুতে যৌথবাহিনীর সদস্যরা রাজনগর শেখপাড়া, হিজুলীসহ আশপাশের গোটা এলাকা ঘেরাও করে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের বাড়ি বাড়ি চিরুনী অভিযান শুরু করে। পালিয়ে যায় গ্রামের সব পুরুষ মানুষ। শেখপাড়ার আসকার আলীর স্ত্রী সেহেরা খাতুন জানিয়েছেন, অবিরাম গুলির শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। আতঙ্কে শিশুদের নিয়ে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কয়েকজনকে আটক করেন। গুলির বিষয়ে সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, অভিযানকালে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও হামলার অভিযোগে ৩৭ জনকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে রাজনগর গ্রামের বিএনপি নেতা আলীহিম মেম্বারের স্ত্রী সোহাগী খাতুনের এক বছর ৯ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাসের কারাদণ্ড এবং রাজনগর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে আনোয়ার হোসেন ও সিরাজুল ইসলামের ছেলে হাসানকে ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও রাজনগর শেখপাড়ার বকুলের স্ত্রী আসমা খাতুন, আজিজুলের স্ত্রী লতিফা খাতুন, আব্দুল বারীর স্ত্রী চাঁন বানু, আকবান আলীর ছেলে মোহাম্মদ মানিক, মৃত মোজাহার শেখের ছেলে সামছুদ্দীন শেখ, মাহাবুবের ছেলে সাজেদুর রহমান, মৃত আব্দুর রহিম বক্সের ছেলে আব্দুল মজিদ, হিজুলি গ্রামের মৃত জবেদ আলীর ছেলে খেদের আলী, মৃত ইলাহী জোয়ার্দ্দারের ছেলে আব্বাস আলী, মহাসীন আলীর ছেলে আব্দুল করিম, মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে আজিজুল, গঞ্জের আলীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম, বারাদী গ্রামের তাহার আলীর ছেলে আলামিন মিয়া, জোহাব আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম, মুজিবনগরের জাকের আলীর ছেলে বিল্লাল হোসেন ও চুয়াডাঙ্গা জেলার কুতুবপুর গ্রামের ভাসান আলীর ছেলে মিজানুর রহমানকে সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণের অপরাধে পেনাল কোডের ১৫২ ধারায় এ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেহেরপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদ হোসেন।
হরতাল-অবরোধ পালনে সরকারি গাছ ও অপটিক্যাল ফাইবার কাটা, সরকারি কাজে বাধা প্রদানসহ সদর থানায় পুলিশের দায়ের করা ৬টি মামলার আসামি হিসেবে ১৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আজ গ্রেফতারকৃতদের আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানিয়েছেন মেহেরপুর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান।
এদিকে রাজনগর শেখপাড়া ও হিজুলী গ্রামে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে পাল্টাপাল্টি ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অভিযানের সময় কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তেমনই এক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন শেখপাড়ার দবির মল্লিকের ছেলে মিন্টু মিয়া। সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ঘরের তিনটি কক্ষের মধ্যে থাকা আসবাবপত্র, বিছানা ও কাপড়-চোপড়সহ সব মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। মিন্টু মিয়ার স্ত্রী মাজেদা খাতুন জানিয়েছেন, তিন মেয়ে নিয়ে তিনি ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। এ সময় কয়েকজন তার বাড়িতে এসে দরজা খুলতে বাধ্য করে। তারা সব জিনিসপত্র ভাঙচুর করে ঘরের মধ্যেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। সোনার গয়নাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। কথা বলার সময় তিনি শুধুই কাঁদছিলেন। এক পর্যায়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন আমাদের শরীরের পোশাক ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন আমরা কোথায় যাবো? কি করবো?
আলেহীম মেম্বারের বাড়িতে দিয়ে দেখা যায় উঠোনে কিছু জিনিসপত্র ও মালামাল পোড়া অবস্থায় রয়েছে। পার্শ্বে কান্নাকাটি করছেন কয়েক নারী ও শিশু। তারাও বর্ণনা করলেন অভিযান ও ভাঙচুরের। আলেহীম মেম্বারের শিশুকন্যা সুরাইয়া ইয়াছমিন জবা কেঁদে কেঁদে বলে আমার মাকে আজকের মধ্যেই ফিরিয়ে দিতে হবে। অভিযানে গ্রেফতারকৃত ৩৭ জনের মধ্যে জবার মাও রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অভিযানের সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ফাঁকা বাড়িতে লোকজন না থাকার সুযোগে তারা এ কর্মকাণ্ড করেছে।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, শেখপাড়া বটতলা ক্লাবঘর, হানু মোল্লার মুদি দোকান, বারেক আলীর বাড়িতে ভাঙচুর এবং আলেহীম মেম্বার, মিন্টু মিয়া, রবিউল ইসলামের দোকান ও খড়ির গাদা এবং আজগর আলীর চায়ের দোকানে ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শেখপাড়ার ঘটনার পর আমঝুপি ইউনিয়নের হিজুলী গ্রামে জামায়াতের সেক্রেটারি আব্দুল জাব্বারের বাড়িতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ঘরের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল ভাঙচুর করে। অভিযান শেষ হলে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা জড়ো হয় হিজুলী গ্রামে। শুরু হয় টান টান উত্তেজনা। বেলা ১১টার দিকে হিজুলী গ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ৪টি দোকানে হামলা করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। হিজুলী গ্রামে অবস্থিত দৈনিক মাথাভাঙ্গার আমঝুপি প্রতিনিধি সাদ আহম্মেদের একটি মার্কেটে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইদ্রিস আলীর সিমেন্টের দোকান, মুকুল হোসেনের মিষ্টির দোকান ও সাইদুর রহমানের গার্মেন্টসের দোকান এবং পার্শ্ববর্তী রবিউল ইসলামের মুদি-কসমেটিক দোকানে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। দোকানের আসবাবপত্র ও মালামাল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
অভিযানের পর থেকেই গোটা এলাকায় শ্মশানের নীরবতা নেমে এসেছে। জেলার বিভিন্ন স্থানের জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মী সমর্থকদের মধ্যে যৌথবাহিনীর অভিযান আতঙ্ক বিরাজ করছে। গা ঢাকা দিয়েছেন অনেকেই। মেহেরপুর পুলিশ সুপার একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেছেন, তাদের কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের মতো। দেশ ও বিদেশের গুরুত্বপুর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম দেশের মূল্যবান সম্পদ ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল ও সড়কের গাছ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এদেরকে কঠোর হস্তে দমনের হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
উল্লেখ্য, বিরোধী দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই রাজনগর এলাকায় আন্দোলন করে আসছিলো।