বিয়ের পর ছেলে পর হয়ে যায়। অধিকাংশ পিতা-মাতার মধ্যেই এরকম ধারণা বা বিশ্বাস বাড়ছে। সঙ্গত কারণও রয়েছে। যে সমাজে ছেলে তার পিতা-মাতাকে মারধর করে। পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য ভুলে নিজের সংসার নিয়েই মেতে থাকে ছেলে সেই সমাজকে আর যাই হোক দায়িত্বশীল সমাজ বলে দাবি করা যায় না। পিতা-মাতাকে ভুলে নিজে নিজের মতো থাকা ছেলের সংখ্যা বাড়ছে বলেই গর্ভধারিণী মাও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনের অজান্তেই বলে উঠছেন, যে ছেলে গর্ভে ধারণ করলাম সেই ছেলেও হয়ে গেলো পর! হায়রে কলিকাল! হায়রে কপাল!
পিতা-মাতার প্রতি ছেলের কর্তব্যহীনতার জন্য সময় নিশ্চয় দায়ী নয়? দোষ কপালেরও নয়। তা হলে দোষ কার? সমাজেরই। সমাজ ওই শিক্ষা দিতে পারেনি, যে শিক্ষা সন্তানকে তার পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ করতে পারে। সমাজের একান্নবর্তী পরিবার প্রথা এখন ইতিহাস। অবশ্যই কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যবস্থা একদিনে বিলীন হয় না। আড়ালে সুক্ষ্মভাবে নিজেকে পৃথককরণের পারিবারিক শিক্ষাই একদিন একান্নবর্তী পরিবার প্রথার ওপর আঘাত হেনেছে। হয়েছে ইতিহাস। তাছাড়া শিশুকালে ওটা তোমার, ওটা ওর বলে ভাগাভাগিতে সাময়িক খুশি করার মানসিকতাও অনেকাংশে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়েছে। তারই কুপ্রভাব রঙ বদলে শুধু পিতা-মাতার ওপরই পড়ে না, সহোদরদের ওপরও পড়ে।
একান্নবর্তী পরিবার, অথচ পিতা বাজার থেকে ভাজা কিনে গোপনে ঘরের মধ্যে ছেলের হাতে তুলে দিলেন। একাকী খেতে বললেন। যে পিতা এমনটি করলেন, তিনি পরিবারের সকল শিশুর জন্য কেন ভাজা কিনলেন না, কেন তিনি সকলের হাতে সমানভাবে ভাগ করলেন না? ওই পিতাও কি তার পিতার নিকট থেকে ওরকম পৃথককরণের শিক্ষা পেয়েছিলেন? হয়তো পেয়েছিলেন, হয়তো পাননি। পরিবারের সকল শিশুর জন্য ভাজা কেনার টাকা হাতে না থাকার কারণে নিজে হয়তো নিজের সন্তানের প্রতি দরদী হয়ে অমনটি করে বসেছেন। একান্নবর্তী পরিবারের ক্ষেত্রে এধরনের পৃথককরণই কি এক সময় বৃহৎ রূপ নেয়নি? শিশুকালেই খেলনা হাতে তুলে দিয়ে যখনই বলা হয় ওটা তোমার, সে তখন নিজেরটা পৃথক করতে শেখে। সেই পৃথককরণ মানসিকতাই এক সময় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধারালো অস্ত্র ধরতে অন্ধ করে।
পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যপরায়ণতার জন্য শুধু ছেলে বা পুত্রবধূই যে দায়ী তা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। পিতা-মাতা জীবিত থাকতে ছেলেরা কেন পৃথক হয়ে নিজের মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে? পরের মেয়ে নিজের পরিবারে এসে কেন শাশুড়িকে আপন করার বদলে বিবাদের বীজ বপন করে? অবশ্যই এক হাতে তালি বাজে না। পুত্রবধূকে দাসি ছাড়া নিজের মেয়ে ভাবতে যখন কষ্ট হয়, তখন পরের মেয়ে কেন তা মেনে নেবে? অথচ নিজের মেয়ে যখন অন্যের পরিবারের সদস্য হয় তখন তার ওপর নির্যাতনের খবর মাকে পীড়া দেয়। তা থেকে ক’জন মা শিক্ষা নেন? মেনে নেয়া এবং মানিয়ে নেয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকে কর্তৃত্ব। ক্ষমতায়ন। এ থেকে মুক্ত হতে না পারাটার দায় কার? কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে পারে আশঙ্কায় পৃথক করা বা নিজের মতো করে নিজের সংসারে কর্তৃত্ব পাওয়ার আশায় পৃথক হওয়ার প্রবণতা মূলত গর্ভধারিনীকে পর করার জন্য অনেকটাই দায়ী। যার বীজ বপনও সেই শিশুকালে।
ছাগলে ভাত খেয়েছে। তা নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে ঝগড়া। স্বামী বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই স্বামীর পিতা-মাতার বিরুদ্ধে নালিশ, আর তাতে কান দিয়ে মাতা-পিতাকে মারপিট। এটা কুলাঙ্গারেরই কাজ। শুধু নিন্দনীয়-ই নয়, গর্হিত অপরাধ। জগতের কোনো পিতা-মাতাই সন্তানের অকল্যাণ কামনা করেন না। নিজের সন্তানের প্রতি কতোটা দরদ, সেই দরদে ন্যূনতম কমতি থাকে না যখন আমি পিতা-মাতার সন্তান। উপলব্ধিবোধ তথা বিবেকবোধ জাগ্রত থাকলে কোনো সন্তানই কি কুলাঙ্গার হয়? ভাবতেও কষ্ট হয়। কুলাঙ্গার হওয়ার আগে সকল সন্তানের বিবেক জেগে উঠুক।