স্টাফ রিপোর্টার: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য গৃহীত হবে কিনা সেই প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি চলছে। আজ বৃহস্পতিবার ফের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এ শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকরের কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেয়া হয়েছে। এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না বলে জানিয়েছেন মাহবুবে আলম ও ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় নির্ধারণ করেছিলো সরকার। এর ৯০ মিনিট আগে সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার বিচারপতি ওই ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন। গতকাল সকাল ১০টা থেকে ফাঁসির রায় কার্যকর করার স্থগিতাদেশ বিষয়ে এবং বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বেঞ্চে এ শুনানি গ্রহণ করেন। এ সময় আইনজীবী ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আদালতে তিলধারণের ঠাঁই ছিলো না। রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার শুনানিতে মাহবুবে আলম বলেন, সংবিধানের ৪৭(ক) (২) অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির রিভিউ আবেদন করার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, এ সংবিধানের অধীন কোনো প্রতিকারের জন্য সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করিবার কোনো অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাদের মোল্লার রিভিউ করার অধিকার নেই। কারণ ১৯৭৩ সালে ট্রাইব্যুনালস আইনে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে দেয়া কোনো আদেশ বা সাজা দেশের কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এ আইনটি জাতীয় সংসদ প্রণয়ন করেছে। সুতরাং সংসদে প্রণীত এ আইন অনুযায়ী রিভিউ চলবে না। কোনো প্রতিকারও চাইতে পারবে না। জবাবে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, রিভিউ কোনো প্রতিকার নয়। এটা সাংবিধানিক ও সুপ্রিমকোর্টের রুলস অনুযায়ী নিজস্ব সহজাত ক্ষমতা। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদের যেকোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোনো ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকবে। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে আপিল বিভাগের ক্ষমতা বোঝানো হয়েছে। প্রতিকারের কথা বলা হয়নি। এখানে ক্ষমতা হচ্ছে সহজাত। এ সময় বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, আদালতের এ ক্ষমতা শর্তযুক্ত। শর্ত হচ্ছে আইনে বেঁধে দেয়া শর্ত। একই সাথে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। জবাবে রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ করা যাবে না সেটা কোথাও বলা নেই। এছাড়া সংবিধানের ৪৭ (৩) অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১, ৩৫ ও ৪৪ অনুচ্ছেদের প্রযোজ্য নয় বলে উল্লেখ রয়েছে। এ তিনটি অনুচ্ছেদকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এখানে ১০৫-এর কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং ১০৫ বলবৎ থাকবে। তিনি সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, কোনো ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোনো দলিলপত্র উদঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যেকোনো মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবেন। এখানে সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার বলতে আদালতের সহজাত ক্ষমতার প্রয়োগকে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের বিধির কথা উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। যেখানে রিভিউ করার বিধান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এ রায় ট্রাইব্যুনাল দেননি। সুতরাং ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে রিভিউ নয়। আপিল বিভাগের রায় নিয়ে রিভিউ হয়েছে। এখানে রিভিউয়ে কোনো বাধা নেই।
এর আগে সকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ফাঁসি কার্যকরের ওপর দেয়া স্থগিতাদেশ বাতিলের আবেদন জানিয়ে শুনানি করেন। অন্যদিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন স্থগিতাদেশের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন জানান। কাদের মোল্লার অন্য আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন জানান, তারা মঙ্গলবার রাতে চেম্বার বিচারপতির কাছে একটি রিভিউ আবেদন জমা দিয়েছেন। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের মামলা। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগে এ মামলার রায় হয়। ৮ ডিসেম্বর রায় হাতে পাওয়ার পর আমরা রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করি। তিনি বলেন, রিভিউ করার জন্য অন্য মামলায় যে সুযোগ রয়েছে, সেই একই সুযোগ এই মামলায়ও পাবো আশা করছি। এটা ৪২ বছরের পুরনো ঘটনার মামলা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার চাই। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ঠিক আছে আপনি গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বলুন। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, আমরা দু দিন সময় চাই, আমাদের প্রস্তুতি শেষ হয়নি। আপনারা যে আদেশ দেবেন, আমরা মেনে নেবো। আমাদের দু দিন সময় প্রয়োজন। এ সময় প্রধান বিচারপতি ব্যারিস্টার রাজ্জাককে বলেন, গ্রণযোগ্যতা নিয়ে বলুন, মেরিট আমরা পরে শুনবো। এটা তো খুবই সংক্ষিপ্ত বিষয়। আপনি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, আপনি সেটা পারবেন। উই আর নট ইন হারি, কিন্তু শুরু করতে দোষ কি? আদালত আবারও রিভিউ বিষয়ক শুনানি করার অনুরোধ জানালে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সময়ের আবেদন জানান। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানির সময় নির্ধারণ করে দেন আদালত। সাড়ে এগারোটার পর শুনানি একটা পর্যন্ত চলে। এরপর আদালত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। শুনানি শেষে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে মিছিল করেছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা।