স্টাফ রিপোর্টার: দেশে অনিশ্চয়তার কালোমেঘের কোণে রূপালি আলোর ছটা দেখা দিলেও তা ফের ম্লান হওয়ার শঙ্কায়। শেষ পর্যন্ত হতাশা ব্যক্ত করেই ফিরে গেলেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। টানা ছয়দিন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রীসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুশীল সমাজ, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক, ছুটোছুটি, শলাপরামর্শ করেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট কাটাতে পারেননি।
বিদায় বেলায় তারানকো বলেছেন, প্রত্যাশাপূরণের লক্ষ্যেই জাতিসংঘের আমন্ত্রণে প্রধান দু দলের মধ্যে যে সংলাপ শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত রাখতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে। আমরা সব পক্ষকে বলেছি, সহিংসতা বন্ধ, বিরোধীদলের নেতাদের মুক্তি এবং নির্বাচনী সিডিউল নিয়ে উদ্বেগের সন্তোষজনক সমাধান সংলাপের মাধ্যমে করতে হবে। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ও সমঝোতার মনোভাব থাকলে এ সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের সংকট নিরসনে পাঁচ দিনের ঢাকা সফর শেষে বুধবার সোনারগাঁও হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে ঢাকার একাধিক সংবাদমাধ্যম নিজস্বসূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, নেতাদের অনমনীয়তায় বেশি দূর এগোয়নি জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় অনুষ্ঠিত বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ। গতকাল অনুষ্ঠিত সংলাপে দ্বিতীয় দফা আলোচনা আটকে যায় তিন পয়েন্টে। বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনার টেবিলে আনা হয় আটক নেতাদের মুক্তির দাবি, দলীয় কার্যালয় পুলিশমুক্ত করাসহ মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্ন করার। একই সাথে ঘোষিত নির্বাচনী তফসিল বাতিলের। আওয়ামী লীগের নেতারা এর কোনোটাই মানতে রাজি নন- যদি না বিএনপি অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের প্রকাশ্য ঘোষণা না দেয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের ওই শর্তে জাতিসংঘ সহকারী মহাসচিবের মধ্যস্ততা এক্সপ্রেস আটকে যায়। আলোচনার থেমে যাওয়ার মধ্যদিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দূতের শেষ সাক্ষাৎও বাতিল হয়ে যায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা সংলাপ এভাবেই সংলাপ শুরু হতে না হতেই তা শেষ হতে চলেছে! যদিও দূতিয়ালি মিশনের প্রধান অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ছাড়ার আগে বলেছেন, সংলাপ চালিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা সম্মত রয়েছেন। তার উপস্থিতিতে দু দফা সংলাপের ধারাবাহিকতায় এবার তারা নিজেরাই বসবেন। নেতাদের সংলাপের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে বলেও আশা করেন তিনি। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেই নিউইয়র্কের পথে রওনা করেছেন জাতিসংঘের রাজনীতি বিভাগের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো। দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন এবং সব দলের অংশগ্রহণে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে এসেছিলেন। ৭-১০ ডিসেম্বর তার সফরের সিডিউল থাকলেও তারানকো ঢাকায় পৌঁছান ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। তার সমঝোতা মিশনের গুরুত্বপূর্ণ দুজন সদস্য ঢাকায় আসেন নভেম্বরের শেষলগ্নে, এক সপ্তা আগে। ওই দুই সদস্য সিরিজ বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মতে, তারানকো মিশনের অগ্রবর্তী টিমের গুরুত্বপূর্ণ ওই দুই নারী সদস্যই আলোচনার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক তৈরি করেছেন। তাদের কাজের সূত্র ধরেই তারানকো এগিয়েছেন। ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৮টা থেকে ১১ ডিসেম্বর রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত মোট ১২১ ঘণ্টা ঢাকায় ছিলেন তারানকো। রাতের ঘুমের সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরো সময়ই তিনি দৌড়ঝাঁপের মধ্যে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রায় দু’ঘণ্টা, বিরোধী দলের নেতার সাথে দু’দফায় প্রায় তিন ঘণ্টা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সাথে এক ঘণ্টাসহ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ ও বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে প্রায় দুডজন বৈঠক করেছেন তিনি। তার মিশনের অপর সদস্যদের স্বতন্ত্র বৈঠকগুলো একসাথে করতে তা চল্লিশের কাছাকাছি হবে বলে জানিয়েছেন সফর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ৬ দিনের সফরের পঞ্চম দিন (মঙ্গলবার) আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের এক সাথে নিয়ে বৈঠক করতে সমর্থ হন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। গুলশানে কঠোর গোপনীয়তায় অনুষ্ঠিত কাঙ্ক্ষিত ওই সংলাপের জন্য এদিনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার দ্বিতীয় দফায় সাক্ষাতের সিডিউলও পিছিয়ে দেয়া হয়। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপের প্রথম রাউন্ড শেষ করে হোটেলে ফিরে এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ‘আলোচনায় অগ্রগতি রয়েছে’ বলে দাবি করেছিলেন তারানকো। বিদায়ের আগে তারানকো তার অনুপস্থিতিতে উভয় দলের নেতারা তৃতীয় দফায় সংলাপের বিষয়ে সম্মত রয়েছেন এবং তারা শিগগিরই এক টেবিলে বসবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে গেছেন।
প্রশ্নোত্তরে যা বলেছেন তারানকো
প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে?
উত্তর: সংলাপ শুরু হয়েছে। আশা করেছিলাম, আমার উপস্থিতিতেই একটি সমঝোতা হবে। অচল অবস্থার মধ্যে তারা দু’বার আলোচনায় বসেছেন। নেতৃত্ব ও তাদের উৎসাহ এই আলোচনাকে এগিয়ে নেবে। আমি আবারও বলছি, সংলাপ চলছে। এই সংলাপের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশ কিভাবে উত্তেজনা প্রশমন করবে সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের। আমি বিস্তারিত বিষয়ে যাব না। আপনারা দেখেছেন বর্তমান সঙ্কটের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুই এই আলোচনায় তোলা হয়েছে এবং তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দু’পক্ষই দৃঢ় প্রস্তাব দিয়েছে এবং তাদের প্রস্তাব পরিষ্কার। দেশেই এই সমস্যার সমাধান হতে হবে।
প্রশ্ন: যে উদ্দেশে আপনি এসেছেন তা কি অর্জিত হয়েছে? উত্তর: আমি মনে করি হ্যাঁ। যখন এসেছিলাম তখন উদ্বেগ ছিল। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। এক. হলো সংলাপ না হওয়া ও দুই. সহিংসতা বৃদ্ধি। উত্তেজনা প্রশমনে সংলাপ, একটি উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ও কিভাবে সমস্যাকে সামনে আনতে হবে এসব বিষয়ে আমার উত্তর। সংলাপ ছাড়া এ সমস্যার সমঝোতায় পৌঁছা খুবই কঠিন। আজকের দিনটি অত্যন্ত কর্মব্যস্ততায় আছি। আপনারা জানেন কতগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ একটি শিডিউলের বিষয়। প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা ও নির্বাচনের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কি বলবেন? উত্তর: এখানে আমি বিস্তারিত বলব না। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ইস্যু তুলেছে। প্রতিটি ইস্যুই বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তব ও গঠনমূলক। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। প্রশ্ন: তাহলে পরিণতি কি? উত্তর: যারা যারা আলোচনায় ছিলেন তারা সবাই জানেন সংলাপ ব্যর্থ হলে কি ঘটবে। সে প্রশ্নের উত্তরে যাব না। এটা নেতৃত্বের ইস্যু। সাহস দেখানোর জন্য এটা একটি সিদ্ধান্তের বিষয়। প্রশ্ন: শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার টোলিফোন সংলাপ নিয়ে কিছু বলবেন? উত্তর: আপনারা কি নির্বাচনের শিডিউল পিছানোর সদিচ্ছার অভাব দেখেছেন। যদি এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব থাকতো তাহলে এত দ্রুততার সঙ্গে আমরা একের পর এক বৈঠক হতে দেখতাম না। তৃতীয় বৈঠকে সবাই একমত হয়েছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ এক সাফল্য। এ সংলাপে সমস্যার সমাধান পেতে সমঝোতা হবে নিশ্চায়ক। শিডিউল পরিবর্তন একটি সম্ভাব্য ইস্যু, যেমনটা আমি বর্তমান পরিস্থিতিতে সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি।
বিদায়ের আগে দফায় দফায় কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক: ঢাকা ছাড়ার আগে দিনের বিভিন্ন সময়ে ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন তারানকো ও তার সফরসঙ্গীরা। প্রধান দু রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তারানকো গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে সকালে গুলশানের প্রভাতি ভবন (ইউএনডিপি’র সাইড অফিস) এ তারানকো মিশনের চার সদস্য বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। কূটনৈতিক সূত্রমতে, সেখানে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, ডাচ্, ইতালি ও ইইউ’র ডেলিগেশন প্রধানরা অংশ নেন। তবে ওই আলোচনায় তারানকো ছিলেন না।