রাজনীতির গোলক ধাঁধাঁ

গিয়াসউদ্দিন পিনা

 

এক নদী জমাট রক্ত ভেদ করে উদীত স্বাধীনতার আরক্তিম সূর্য যখন সাফল্যের অনেকখানি পথ অতিক্রম করে স্বমহিমায় মধ্যগগণে বিরাজমান, ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত সূর্যগ্রহণের মতো রাজনীতির আকাশে এক দূরপনেয় বিভীষিকা তার সবটুকু থাবা বিস্তার করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতকে খাঁমচে ধরে অন্ধকার গহ্বরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যেখান থেকে সহসা উত্তরণের কোনো আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চারিদিকের বাতাস ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে পোড়ামানুষের উৎকট গন্ধে। হায়েনার হিংস্রতায় রাজপথ হয়ে উঠেছে নৈরাজ্যের নিবাস। রাজনীতির কুটিল আবর্তে পড়ে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নিত্য নতুন মুখ। লাল সবুজ পতাকা আরো রক্তিমাভ হয়ে উঠছে নিরীহ মানুষের সতেজ রক্তে। এদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য আর কতো উর্বর রক্তের প্রয়োজন? ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তও কি যথেষ্ট নয়? একটি জীবন, একটি পরিবারের জন্য কি অমূল্য সম্পদ তা বোঝা যায়, যখন তা ঝরে যায়। আর সে ঝরে যাওয়া পুষ্পটি যদি রাজনৈতিক ঝড়ে বৃন্তচ্যুত হয়, তখন তা হয়ে উঠে অতি মর্মান্তিক। আমজনতা শ্রদ্ধা হারাতে থাকেন রাজনীতির প্রতি। অজস্র লাশের নীরব কান্না না জানি কখন অভিশাপের প্লাবণ হয়ে আমাদের সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় প্রাগৈতিহাসিক জামানায়। একথা সর্বজনবিদিত যে, দলের চেয়ে দেশ বড়, তার চেয়ে মানুষ। সভ্যমানুষের বসবাসের জন্য যেমন একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন, তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একাধিক রাজনৈতিক দলেরও প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই রাজনৈতিক দলের মুখ্য উদ্দেশ্য। এদেশের রাজনৈতিক ময়দানে অনেক দলের অংশগ্রহণ থাকলেও মূলত এ ও বি দলই রাজনীতির মাঠে সেরা দল হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এ দুটি দলের নেতাদের পরষ্পরের আচরণ আজ এতোটাই বিদ্বেষমূলক হয়ে উঠেছে যে, তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নেতা থেকে সমর্থক পর্যন্ত সকলেই আজ অক্লেশে শাদাকে শাদা বলতে দ্বিধা করছেন। এক অদৃশ্য দেয়াল সত্য কথনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে রাজনৈতিক আবহ হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী। অথচ উভয় দলেই মেধাবী ও প্রাজ্ঞ নেতার কোনো অভাব নেই। অভাব যা, তা হলো সহিষ্ণুতার, উদারতার। এ যেন ফুটবলে আবাহনী, মোহামেডান লড়াইয়ের মতো। এক সময় ঢাকা লিগে আবাহনী, মোহামেডানের ফুটবল লড়াই ছিলো কিংবদন্তীর মতো। এখানে হেরে যাওয়ার অর্থ শুধু বেইজ্জতি হওয়ায় নয় বরং শিরোপার লড়াই থেকে ছিঁটকে যাওয়া। অ-নে-ক দিন আগে বন্ধু জাহিদ হোসেন লিটন (বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক) ও আমি মোহামেডান-আবাহনীর ফুটবল লড়াই দেখার জন্য ঢাকা স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। গ্যালারিতে ছিলো উপচেপড়া ভিড়। সমর্থকরা স্ব স্ব দলের ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে নৃত্যগীতে স্টেডিয়াম মুখর করে রেখেছিলো। দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে, অনেক ঘাম ঝরিয়ে আবাহনী গ্যালারির পাদদেশে ভাগ্যগুণে একচিলতে বসার জায়গা পেয়েছিলাম। খেলা শুরুর পর থেকেই আমি তন্ময় হয়ে খেলাটি উপভোগ করছিলাম। আমার ফুটবল নায়কদের লাইভ পারফরম্যান্স আমাকে মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রেখেছিলো অনুক্ষণ। সে ছিলো এক অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম শিহরণ। তাদের ছান্দনিক খেলার তাল-লয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম স্বপ্নীল অনুভবে। খেলার মাঝপথে বিতর্কিত রেফারি নাজির হোসেনের অতর্কিত ফাউলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে খেলোয়াড়দের মধ্যে  সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিলো, আর মূহুর্তেই তা সংক্রমিত হলো সমর্থকদের মাঝে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো অঘোষিত কুরুক্ষেত্র। আবাহনী-মোহামেডান পাশাপাশি দুটি গ্যালারির মধ্যে বৃষ্টির মতো ইস্টক নামক মিসাইল বর্ষণ শুরু হলো। প্রাণ বাঁচানো ফরজ ভেবে ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে যখন বাইরে বের হয়ে এলাম, দেখি আমার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে, আর জাহিদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। এতো সুন্দর একটা খেলা পণ্ড করে দেয়ার জন্য আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো রেফারির ওপর। জাহিদকে বললাম, ব্যাটা রেফারি ইচ্ছে করলে ছোট এ ফাউলটাকে উপেক্ষা করতে পারতো। তাহলে অন্তত গণ্ডগোলটা হতো না। বলে রাখা ভালো, আমি ছিলাম আবাহনীর সমর্থক, জাহিদ মোহামেডানের। জাহিদ আমার কথা লুফে নিয়ে বললো, রেফারি নিয়ম মোতাবেকই ফাউল ধরেছে। এটা নিশ্চয়ই রাগবি খেলা নয় যে, গায়ের জোরে খেলতে হবে। আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইউরোপিয়ান লিগের খেলাগুলোতে রেফারি এ ধরনের ছোটখাটো ফাউলকে এড়িয়ে যান খেলার গতি ও ছন্দ বজায় রাখার স্বার্থে। সে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বললো, এদেশে এখনও সে ধরনের কালচার গড়ে ওঠেনি। বেশ কিছুক্ষণ চললো আমাদের দুজনের এ যুক্তিতর্ক। আমাদের এ মতপার্থক্যটা ছিলো শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির। এ রকম তর্কাতর্কি নতুন কিছু নয়। আবহমান কাল থেকেই এ ধরনের মতভেদ চলে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাজনীতিতে যার প্রকাশ সর্বত্রই স্পষ্ট। নেতৃবৃন্দের একটুখানী উদারতা, কিংবা ছাড় দেয়ার মানসিকতা যে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে শ্রেষ্ঠ টনিক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে আমজনতার বিশ্বাস।

 

গিয়াস উদ্দিন পিনা

দর্শনা

মোবাইল; ০১৭১২-৬৫৯২৮৪