মাথাভাঙ্গা মনিটর: দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মহান নেতা ও বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতির কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব নেলসন ম্যান্ডেলা আর নেই। গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা শোকাবহ এ খবরটি টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবগত করেন। তিনি জানান, দক্ষিণ আফ্রিকার সময় বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৫০ মিনিটে জোহানেসবার্গে নিজ বাসভবনে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মহাপ্রয়াণ ঘটেছে এ মহানায়কের। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় তিনি পরিবার-পরিজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিলেন। তার বয়স হয়েছিলো ৯৫ বছর।
পূর্ণরাষ্ট্রীয় সম্মানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে প্রেসিডেন্ট জানান। তিনি আরো জানান, যতদিন পর্যন্ত নেলসন ম্যান্ডেলার সমাধি না হবে ততোদিন তার দেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। মৃত্যুর আগে ফুসফুসের সাথে দীর্ঘদিন লড়াই করেন তিনি। এ মহানায়কের চিরপ্রস্থানের ঘোষণা শুনেই গোটা বিশ্ব যেন ডুবে যায় শোক সাগরে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গৌরবোদীপ্ত, মর্যাদাবান ব্যক্তি ও দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের কাছে প্রমেথিউসের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নেলসন ম্যান্ডেলা। গহীন আফ্রিকার কৃষ্ণগহ্বর থেকে যজ্ঞ হুতাগ্নির মতো বেরিয়ে এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। মনুষ্যসমাজে দানবদের বিরুদ্ধে এক জান্তব দুঃসাহস তিনি; এ পুরুষোত্তম ব্যক্তিত্ব আফ্রিকার কুজ্ঝটিকা ও কুহেলিকা ভেদ করে প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় জ্বলে উঠেছিলেন। ধূমকেতুর শিখা তিনি। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী কুশাসন ও পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করে এক তমসাচ্ছন্ন আকাশকে আবার তার নীল দরিয়ার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছেন ম্যান্ডেলা। বিগত শতাব্দীর প্রথম ভাগে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রানসকেই প্রদেশের রাজধানী উমতাতার নিকটবর্তী অজপাড়াগাঁ এমভেজোর এক পর্ণকুটির থেকে একদিন রোলিলাহলা নামক যে বালকের উত্থান ঘটেছিলো পরবর্তীতে দৃঢ় সংকল্পবোধ, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, পরিশ্রম, অসীম ধৈর্য আর ক্ষুরধার সংগ্রামী চেতনার মধ্যদিয়ে সেই বালকই বিশ্বের অন্যতম প্রধান বরেণ্য ব্যক্তিত্বের অভিধায় অভিষিক্ত হন।
নেলসন ম্যান্ডেলা নামটির মধ্যে মানুষের সংগ্রামী আলেখ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। ম্যান্ডেলা মানুষের মুক্তির আকুতিকে ভাষা দিয়েছেন এবং সে মুক্তিলাভের জন্য গণমানুষকে অকুতোভয়ে লড়ে যাওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি। বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানবাত্মার ক্রন্দনধ্বনি তার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিলো। তিনি যেন অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই জগত্বাসী জীবনযুদ্ধের এ লড়াকু সৈনিককে ন্যায়বিচার, সাম্য আর আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামের প্রতীকরূপে বরণ করে নিয়েছে। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে নয়; তাবত্ বিশ্বের দুর্বল-অসহায় ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কাছে সংগ্রামের প্রেরণা ছিলেন তিনি।
রাজনীতিতে নেমে শঠতার আশ্রয় নেননি এমন নেতা বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু ম্যান্ডেলার চরিত্রে এহেন কলঙ্ক আরোপের অবকাশ নেই। তিনি নেতার কাতারে ছিলেন অগ্রগণ্য নেতা, জনতার কাতারে জনতারই অংশ। তিনি জানতেন যে, পরহিতব্রতী রাজনীতি রাজনীতিককে করে মহান আর স্বার্থের রাজনীতি রাজনীতিকের জীবনে আনে জগেজাড়া ধিক্কার। এ শিক্ষা আফ্রিকার অজপাড়াগাঁর সেই বালকটির মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো আর তার সুষ্ঠু পরিচর্যার পরাকাষ্ঠা জগৎ দেখতে পেলো একজন সাধারণ বালকের ঋষিত্বে উন্নীত হবার সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্যে। ম্যান্ডেলা তার গোত্রের লোকদের কাছে মাদিবা নামে পরিচিত ছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার জন্য সংগঠন করেছেন, প্রস্তুতি নিয়েছেন। ১৯৬২ সালে গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়ার জন্য তিনি গোটা আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড সফর করেছিলেন। বৈপ্লবিক কৌশলাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে এবং সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বিভিন্ন দেশ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে নিজেদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন লাভের ব্যাপারেও তিনি এ সফরকে কাজে লাগান। কিন্তু দেশে ফেরার পরই তিনি কারারুদ্ধ হন।
১৯৯৪ সালের ২৭ এপ্রিল দেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তাতে জয়লাভ করে এবং ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বর্ণবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের এ অন্যতম পুরোহিত ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সর্বাপেক্ষা যে মহতী উদ্যোগটি গ্রহণ করেন তা হলো শ্বেতাঙ্গদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ না করে জাতিকে তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপারে দীক্ষা প্রদান। তার এই অহিংস নীতি মহাত্মা গান্ধীর নীতিরই অনুবর্তী এবং তার এ মহানুভবতা তাকে বিশ্বের সর্বত্র আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৯ সালে সারাদেশের মানুষের অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দেন। ২০০১ সালে তার প্রষ্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। ২০০৪ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। ২০০৯ সালে ম্যান্ডেলার ৯০তম জন্মদিন (১৮ জুলাই) জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে পালন করে। ১৯৯৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সাথে যৌথভাবে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই রোলিলাহলা ম্যান্ডেলার জন্ম। তিনি তার গোত্র এবং আফ্রিকার নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচারকে চিরকাল গভীর মর্যাদা দিয়ে গেছেন। নিজ দেশাচার এবং গোত্রের যাবতীয় সংস্কৃতি চেতনাকে জীবনভর গভীর মমত্বের সাথে লালন করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা বা বিজ্ঞান আমাদের বর্তমান মানস গঠনের মূল উপাদান বটে কিন্তু প্রতিটি গোত্রের বা জাতির স্ব স্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান এগুলোর পিছনেও আছে গভীর জ্ঞানময়তা। আসলে ম্যান্ডেলার জীবন ছিলো মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও আদর্শ তাড়িত। নিজেকে ক্ষমতাবান করে তোলা নয় বরং একটি বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো তার জীবন সাধনা ও সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। সে আদর্শকে অর্থাৎ উন্নত মানবাত্মার মহিমার জয়গান এবং দোষে-গুণে ভরা মানুষের মধ্যকার সুপ্ত শুভ-চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে তিনি কন্টকাকীর্ণ পথে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সাহস নিষ্ঠা দৃঢ়তা মমত্ববোধ ধৈর্য সহনশীলতা ইত্যাদি গুণগুলোর বিকাশ সাধনের মাধ্যমে নিজেকে এ বিশ্বের অন্যতম এক সুমহান ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করেছেন।
মার্কিন পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ ওবামার: ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের শোক জানাতে বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসসহ বিভিন্ন সরকারি ভবনে পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন। ওবামার এ ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিদেশে মার্কিন মিশন, সামরিক ঘাঁটি, নৌ ঘাঁটি ও সামরিক জাহাজে পতাকা অর্ধনমিত রাখার জন্য তার নির্দেশ বহাল থাকবে।
ম্যান্ডেলার দু কন্যা জানলেন যেভাবে: লন্ডনে বসে পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনলেন নেলসন ম্যান্ডেলার দু কনিষ্ঠ কন্যা। বৃহস্পতিবার ছিলো ম্যান্ডেলার জীবনের ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের লন্ডন প্রিমিয়ার। ‘ম্যান্ডেলা:লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ নামের চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে ম্যান্ডেলা কন্যা জিন্দজি ও জেনানি কেবলমাত্র ব্রিটেনের প্রিন্স উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেটসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এমন সময় টেলিফোনে তাদের পিতার মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। আর তারা তাত্ক্ষণিকভাবে প্রিমিয়ার শো ত্যাগ করেন। আগামী ১৪ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাকে শেষ শয়ানে শায়িত করা হবে; যার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে মৃত্যু ঘোষণার সাথে সাথে। তার শেষকৃত্যে অংশ নেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।