স্টাফ রিপোর্টার: রাত তখন পৌনে চারটা। হঠাত তালা কাটার শব্দ। বিএনপি কার্যালয়ের ঘুমভাঙা কর্মচারীদের চোখে মুখে ঔৎসুক্য। একটু পর তারা দেখলেন রাস্তা থেকে মই দিয়ে দোতলার রেলিঙে উঠে আসছে শাদা পোশাকের একদল লোক। কয়েকজন কাটার দিয়ে কাটছে দোতলার দরজায় লাগানো তালা। অল্পক্ষণেই তালা কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের শাদা পোশাকধারী সদস্যরা। একে একে ভাঙচুর করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কক্ষের আসবাবপত্র। তারপর তাদের একদল ওঠে তিনতলায়। সেখানে প্রথমে মহাসচিবের কক্ষের তালা ভেঙে তল্লাশি ও পরে দপ্তর সম্পাদকের কক্ষের কাঁচের দরজা ভেঙে তল্লাশি করা হয়। এ সময় দপ্তর থেকে যুগ্মমহাসচিব রিজভী আহমেদ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলাল আহমদকে আটক করা হয়। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা রিজভী আহমেদকে লুঙ্গি পাল্টানোরও সময় না দিয়ে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে কার্যালয় থেকে বের করা হয়। এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টারও লাঞ্ছিত হন। তাদের ছবি তোলার সুযোগ না দিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সময় টিভির ক্যামেরা। তিনতলায় যখন শাদা পোশাকধারীদের একদল এ গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছিলো তখন সিঁড়ির শাটার ও গ্রিলের তালা কাটে আরেক দল। শুক্রবার শেষ রাতে বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এভাবেই চালিয়েছে ৪০ মিনিটের অভিযান। অভিযানে শাদা পোশাকে মহানগর পুলিশের প্রায় ৩০ জনের একটি দল অংশ নেয়। এর আগেও গত ১১ই মার্চ সন্ধ্যারাতে প্রথমবারের মতো বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৫৮ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছিলো পুলিশ। এ ঘটনার পর ব্যাপক সমালোচনা হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। গতকালের ঘটনায়ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিন্দা জানিয়েছে। শেষ রাতে মই বেয়ে রেলিং দিয়ে কার্যালয়ে প্রবেশকে জলদস্যুদের মতো অভিযান বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। ওদিকে গত ৮ নভেম্বর রাতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার অভিযান শুরু হলে জাতীয় প্রেসক্লাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়া রিজভী আহমেদ শেষ রাতে কৌশলে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। তারপর থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ছিলেন তিনি। সিনিয়র নেতারা যখন চলমান আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মামলা জটিলতা ও গ্রেফতার এড়াতে দলীয় সিদ্ধান্তে নিরাপদ অবস্থানে যান তখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে আপৎকালীন মুখপাত্র হিসেবে সার্বিক বিষয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতেন রিজভী।
এদিকে অভিযান চলাকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ৭১-এর সিনিয়র রিপোর্টার শফিক আহমেদ ও গাজী টিভির সিনিয়র রিপোর্টার গাউসুল আজম বিপু। শফিক আহমেদ জানান, রাতে চ্যানেল ৭১-এর একটি লাইভ টকশোতে অংশ নিয়েছিলেন রিজভী আহমেদ। সে টকশো শেষ হতে রাত একটা বেজে যায়। বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তিনি বলেন, রাত সাড়ে তিনটার কিছু পরে তালা ভাঙার শব্দ হয়। এ সময় আমরা কয়েকজন তিনতলায় জেগেছিলাম। আমরা তখন শব্দের উৎস জানার জন্য দোতলায় যাওয়ার সাথে সাথে কয়েকজন শাদা পোশাকধারী পুলিশ আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। পরিচয় জেনে নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের মোবাইলফোন জব্দ করে দোতলার একটি কক্ষে আটক করে রাখে। পরে রাত সোয়া চারটার দিকে কক্ষের জানালা দিয়ে দেখতে পাই রিজভী আহমেদ ও বেলাল আহমেদকে নিয়ে শাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মচারী আবদুল গাফফার বলেন, আমরা কার্যালয়ের তিনতলায় ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে শাদা পোশাকের ১২-১৫ জনের একটি পুলিশের দল অফিসের সামনে মই লাগিয়ে দোতলার বারান্দায় ওঠে। পরে তারা মেশিন দিয়ে তালা কেটে ভেতরে ঢোকে। দোতলায় তারা চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কক্ষসহ প্রত্যেকটি কক্ষের দরজার তালা ভেঙে ভেতরে তল্লাশি চালায়। এরপর তালা ভেঙে তিনতলায় মহাসচিবের কক্ষে ঢুকে তল্লাশি চালায় ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। সেখান থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলাল আহমেদকে আটক করে। গাফফার বলেন, দরজার তালা ভাঙার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। শাদা পোশাকের পুলিশ তিনতলার ব্রিফিং রুমে ঢুকে আমাদেরকে এক পাশে আটক করে রাখে। পুলিশ তিনতলায় এসে রিজভী কোথায় বলে ডাকাডাকি করতে থাকে। তারপর কাঁচের দরজা ভেঙে দপ্তর সম্পাদকের কক্ষ থেকে রিজভী আহমদকে আটক করে। এরপর দপ্তরে ঢুকে রিজভী আহমেদের শার্টের কলার ধরে নামিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। তখন রিজভী আহমেদ লুঙ্গি পরা ছিলেন। রিজভী প্যান্ট পরতে চাইলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে কলার ধরে চোখ বেঁধে নামিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে একটি শাদা মাইক্রোবাসে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় দোতলা ও তিনতলায় প্রতিটি কক্ষের দরজার তালা, আসবাবপত্র, ফাইল কেবিনেট, ভাঙচুর, তছনছ, রিজভী আহমদের ব্যবহারের ল্যাপটপ, আলমারি, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, দাপ্তরিক কাগজপত্র ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও দাপ্তরিক খরচের টাকা নিয়ে যায়। অভিযানের দৃশ্য ধারণ করতে গেলে টেলিভিশন সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করে ডিবি পুলিশ। সময় টেলিভিশনের একটি ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রিজভী আহমেদকে আটকের জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপি কার্যালয়ে মই দিয়ে দোতলার রেলিং ওঠার আগে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে রাতে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পাশের গলিতে সরিয়ে নেয়া হয়। এদিকে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মমহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেফতারের পর দলের দপ্তরের দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মৎস্যভবন মোড়ে গাড়িতে পেট্রোল বোমা হামলার মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামসহ বিএনপি ও অঙ্গদলের ১৭ শীর্ষস্থানীয় নেতাকে আসামি করা হয়। সে মামলায় রিজভী আহমেদ ও বেলাল আহমেদকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
এদিকে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দোতলার উত্তর পাশের দরজাটির তালা ভাঙা। প্রতিটি কক্ষের আসবাবপত্র এলোমেলো। তৃতীয় তলায় মহাসচিবের কক্ষের দরজার তালা কাটা। ড্রয়ারগুলো খোলা ও কাগজপত্রগুলো ছড়ানো-ছিটানো। এমনকি মহাসচিবের চেয়ারটিও উল্টে পড়ে আছে। মহাসচিবের একান্ত কক্ষের প্রতিটি জিনিসসহ বিছানাপত্র এলোমেলো পড়ে আছে। মেঝেতে পড়ে আছে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্লাস্টিকের মুৱ্যালটি। তৃতীয় তলায় দপ্তর সম্পাদকের কাঁচের দরজাটি ভাঙা। ড্রয়ারসহ ফাইলপত্র এলোমেলো। তার একান্ত কক্ষের বিছানায় পোশাক-আশাক ও কাগজপত্রের স্তুপ। পঙ্গু রিজভী আহমদের ব্যবহৃত লাঠি পড়ে আছে মেঝেতে। ওষুধপত্রও ছড়ানো ছিটানো। দপ্তরের কম্পিউটার কক্ষের দুটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নেই। ওয়াল কেবিনেটের প্রতিটির ড্রয়ার খোলা। সেখানে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দাপ্তরিক কাগজপত্র। কার্যালয়ের সিঁড়ির মুখের টয়লেট ও সিঁড়ির শাটারের তালাগুলো কাটা। কার্যালয়ের কর্মচারীদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো কাঁপছেন বয়োবৃদ্ধ কর্মচারী দলিল উদ্দিন। তিনি বিএনপি কার্যালয়ের আগেরবার অভিযানের সময় গ্রেফতার হয়ে রিমান্ড ও দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। রাতের ডিবি পুলিশের অভিযান ও রিজভী আহমদকে গ্রেফতারের পর রীতিমতো নেতাকর্মী শূন্য হয়ে পড়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর। ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকারের সময়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলে দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ ছিলো দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
এদিকে দুপুর ১২টা ৪০মিনিটে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান আইনজীবী ও সাংবাদিক নেতারা। সুপ্রিম কোর্ট বারের সহসভাপতি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক খোরশেদ আলম মিয়া, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া, বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, সহসভাপতি আমিরুল ইসলাম কাগজী, ডিইউজে সভাপতি আবদুল হাই শিকদার ও ড্যাব সদস্য ডা. রফিকুল ইসলাম। দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিজভীকে গ্রেফতারের পর নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ে আইনজীবীরাই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে কার্যালয়ে যাওয়ার সময় নয়াপল্টন থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওদিকে দলের দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হলেও কার্যালয়ে যেতে পারেননি সালাউদ্দিন আহমদ। দুপুরের পর থেকে ফোন বন্ধ রেখে তিনিও নিরাপদ অবস্থানে থেকে দলের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। এদিকে পুলিশ কক্সবাজারের পেকুয়ায় সালাহউদ্দিন আহমদের গ্রামের বাড়িতে তার খোঁজে তল্লাশি চালায়।
রিমান্ডের আবেদন: আটক বিএনপি নেতা রিজভীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না পেয়ে শুনানির জন্য ৪ ডিসেম্বর শুনানির তারিখ ঠিক করেছেন বিচারক। একই সাথে জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বিরোধীদলের গত সপ্তার ৭১ ঘণ্টার অবরোধের শেষ দিন শাহবাগে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় রিজভীকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।