স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ পার্লামেন্ট মুলতবি হতে না হতেই আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সঙ্কট বিশ্বের দু’টি শক্তিশালী পার্লামেন্টের আলোচনায় এসেছে। নতুন নির্বাচনে যেতে বাংলাদেশ সংসদ তার শেষ বৈঠক করলো বুধবার। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দু মহাশক্তিধর সংসদ একযোগে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়েই প্রকাশ করলো গভীর উদ্বেগ।
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে কার্যত সমস্বরে খাদে না পড়তে হুঁশিয়ার করে দেয়ারই চেষ্টা করেছে। তিন বছর আগে শেখ হাসিনার প্রথম এটর্নি জেনারেলের ভবিষ্যদ্বাণীও গত ২১ নভেম্বর মার্কিন কংগ্রেসে প্রশ্ন হিসেবে উঠেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম বলেছিলেন, এটা বাতিল করলে সামরিক শাসন আসবে। মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে প্রশ্ন এসেছে সেনা হস্তক্ষেপ কি হতে পারে? একজন বাংলাদেশি জেনারেল (অব.) নাকচ করেননি। বলেছেন সহিংসতা চলতে থাকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হতে পারে। ইইউ পার্লামেন্ট বিরোধীদলকে নির্বাচন বর্জন না করতে এবং সরকারি দলকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সুপারিশ থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এখন সর্বত্র প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে? বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রথম সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী ইস্যু বা সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের যথেষ্ট আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে। বাংলাদেশ রাজনীতিতে এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই তুলনামূলক সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। এবারে অনেক প্লেয়ার। পুরনো মাঠ। কিন্তু নতুন জার্সি, নতুন বুট।
২০০৬ সালেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে ঘন ঘন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে যেতে দেখা গেছে। শোনা যাচ্ছে, এবারে তাতে অরুচি ধরেছে। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে সংলাপে বসতে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সাথে আলোচনায় বসতে আওয়ামী লীগকে জবর প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। তখন বিএনপি নাকচ করেছিলো। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। জাতিসংঘকে অনেক আগ থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তাদের প্রতিনিধিদল ঢাকা ঘুরে একাধিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। তখন তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতির দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপরই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে দিল্লি যান। এরপর সেখানকার পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় যে, বাংলাদেশে নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গেছে। এরপর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার নির্দিষ্টভাবে তথ্য প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করছেন।
ইতোমধ্যে চীনা দূতাবাসের বিবৃতিতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। চীন ও ভারতের এ রকম সক্রিয় ভূমিকা এর আগে দেখা যায়নি। সুতরাং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এবারের বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে কেবলই অভ্যন্তরীণ কিংবা সাংবিধানিক সঙ্কট হিসেবে দেখছেন না। নেপালেও অশান্তি চলছে। ১০ দিনের হরতাল ডেকেছে বিরোধী দল। সেখানে গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নই করতে পারছে না। কিন্তু নেপালের পরিস্থিতির তুলনায় বাংলাদেশ আলাদা। নেপাল আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে গণ্য হয় না। কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বহুমাত্রিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে।
নিউ ইর্য়ক টাইমসের গত ২০ নভেম্বরের সম্পাদকীয় অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। লন্ডনের প্রভাবশালী সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার সম্পর্কে গোড়া থেকেই কঠিন মনোভাব গ্রহণ করে চলেছে। ২০ নভেম্বরের নিউ ইর্য়ক টাইমস এতোদিন ধরে বলে আসা দি ইকোনমিস্টের সম্পাদকীয় ভাষ্যকে অনুমোদন দিয়েছে। দুটি বিষয় তারা সরাসরি চিহ্নিত করেছে। প্রথমত: বর্তমান সঙ্কটের দায়ভার তারা নির্দিষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়েছে। বিরোধীদলকে প্রতিহত করতে যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণে শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোভাবের কথা পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। দ্বিতীয়ত: মানবাধিকার লঙ্ঘন চলতে থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সেনাকুঞ্জে সাক্ষাত এবং সংলাপ প্রশ্নে কথোপকথনের পর এ বিষয়ে নতুন করে কৌতূহল শুরু হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত নানা উদ্যোগ ও কথা হলেও বাস্তবে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের তাগিদের কথা বলা হলেও বিরোধী দল তা অস্বীকার করছে। তারা বলছে, সেনাকুঞ্জে সংলাপ আয়োজনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কোনো কথা বলেননি। উভয় পক্ষ থেকেই দাবি করা হচ্ছে, তারা সংলাপের বিষয়ে আন্তরিক।
নিউ ইর্য়ক টাইমস আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন পুনরুজ্জীবন, মানবাধিকার কর্মীদের নিপীড়ন বন্ধের এবং নির্বাচনকালীন একটি গ্রহণযোগ্য ক্রান্তিকালীন সরকার গঠনে রাজনৈতিক বিরোধীদের সাথে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একই দিনে মানবাধিকার এবং আসন্ন নির্বাচন শীর্ষক একটি রেজুলেশন পাস করেছে। ওই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের দুই দফায় বলা হয়েছে, প্রাক-নির্বাচনকালে সরকার কীভাবে তার ক্ষমতার অনুশীলন করবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ পার্লামেন্ট একটি সর্বদলীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলো না। এজন্য ইইউ সংসদ দুঃখ প্রকাশ করছে। এতে অবশ্য বলা হয়, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই প্রাক-নির্বাচনী সময়টা যদিও অতিক্রম করে থাকে। তাই তারা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধীদলের প্রতি বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে জরুরি ভিত্তিতে আবেদন জানিয়েছে। তারা আশা করেছে যে, বাংলাদেশের জনগণ যাতে তাদের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারে, সেজন্য তারা একটি আপস রফায় পৌঁছাতে পারবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের ৫ দফায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রতি আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সাথে সংগঠিত ও তদারকি করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তাদের একটি প্রস্তাবে রহস্যজনক সংগঠন বিএনএফ’র প্রতি কি ইঙ্গিত করা হয়েছে? কারণ ইইউ বলেছে, নির্বাচন কমিশন যাতে নতুন রাজনৈতিক দলসমূহকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নবাগতের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব অর্জনের সঙ্গত বৈশিষ্ট্য অর্জন করার বিষয়টি খেয়ালে রাখে। এ বিষয়টিকে সমর্থন দিতে ইইউ বাংলাদেশের ইসি’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে নিউ ইর্য়ক টাইমসের সম্পাদকীয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রেজুলেশনের মধ্যে মিল-অমিল বেশ লক্ষণীয়। ২০ নভেম্বর নিউ ইর্য়ক টাইমস সরাসরি বলেছে, ৭১-এ সংঘটিত নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করেছে। এ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার আরেকটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পরেই ‘অধিকার লঙ্ঘন চলতে থাকলে’ বাংলাদেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা টেনেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে দু’টি দফায় তাদের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছে।
তারা তাদের প্রস্তাবের সাত দফায় বলেছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সংঘটিত অপরাধের রিকন্সিলিয়েশন বা বোঝাপড়া, বিচার এবং জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা ইইউ স্বীকার করছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে তাকেও সমর্থন দিচ্ছে। তবে আট দফায় তারা বলেছে, বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ইইউ নিন্দা করছে। এ প্রসঙ্গে তারা ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে অভিযুক্তদের গণমৃত্যুদণ্ড দানের বিষয়টিও উল্লেখ করে। তারা তাদের সিদ্ধান্তে বলেছে যে, ইইউ ন্যায্য বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) বিষয়ক যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মান রয়েছে তা প্রয়োগ করতে তারা গুরুত্ব আরোপ করছে। এগার দফায় মানবাধিকার কর্মীদের অধিকার লঙ্ঘন, হুমকি, আক্রমণ, হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অবিলম্বে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছে। এ প্রসঙ্গে তারা নির্দিষ্টভাবে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং সাংবাদিক সাগর সরয়ার ও মেহেরুন রুনির কথা উল্লেখ করেছে।
উল্লেখ্য যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের অনুলিপি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ভুক্ত সকল দেশের সরকার ও পার্লামেন্টের কাছে পাঠিয়েছে। পাঠিয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের কাছেও। আরও পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকার এবং তার পার্লামেন্টের কাছে। স্পিকার শিরিন শারমিন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার নজরে নিতে পারেন। তিনি তা নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের নজরেও। সংসদের অধিবেশন মুলতবি হলেও যে কোন সময় সংসদ ডাকা যাবে। এমনকি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও সংসদের বৈঠক করতে কোন বাধা হবে না। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের রেজুলেশনের বিষয়টি তারা আলোচনা করতে পারে। ওই রেজুলেশনে এটাও স্মরণ করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশে পাঁচটি আঞ্চলিক নির্বাচন হয়েছে। এর প্রত্যেকটিতে আওয়ামী লীগ পরাস্ত হয়েছে এবং অনিয়মের কোন অভিযোগ উঠেনি।
তবে এটা লক্ষণীয় যে, ভারতীয় গণমাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াতকে বাদ দিয়ে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় যখন খবর প্রকাশিত হয়, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার যখন বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেন তখন ক্ষমতাসীন দল থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় না। অথচ মার্কিন কংগ্রেসে শুনানি অনুষ্ঠান প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সবারই জানা আমেরিকায় লবিং গ্রুপ কিভাবে কাজ করে। বিশেষ করে জামায়াত লবিং প্রচণ্ড শক্তিশালী। তারা পয়সা দিয়ে বড় বড় লবিস্ট নিয়োগ করে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা দায়ী কিনা? নিউ ইর্য়ক টাইমসের নাম উল্লেখ না করে বিবিসি’র সংবাদদাতা এইচটি ইমামের কাছে ওই প্রশ্নটিই রেখেছিলেন। তাঁর উত্তর- ‘শেখ হাসিনার উপর দায়ভার বা অভিযোগ করার বিষয়টি যে কোন বিবেকবান মানুষে বলবেন এটা সম্পুর্ণ মিথ্যা।’