স্টাফ রিপোর্টার: হরতালের যতো ধকল তার সবই পোহাতে হয় শহরকে। গ্রাম ও গ্রামের সাধারণ মানুষ কাজ শেষে মাচায় অথবা চা দোকানের চৌকাঠে সরোব আলোচনার মধ্য দিয়েই পার করেন হরতার। ১৮ দলের ডাকা টানা ৬০ ঘন্টার হরতালের প্রথম দিনে চুয়াডাঙ্গার গ্রামবাংলার চিত্রটা কেমন? তা দেখতেই গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলার জুড়ানপুর, নতিপোতা, কার্পাসডাঙ্গা ও দামুড়হুদা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম সরেজমিন পরিদর্শনকালে এলাকার মানুষকে কর্মমুখী ও দৈনন্দিন সাভাবিক কাজে নিযুক্ত থাকতে দেখা যায়।
দামুড়হুদা উপজেলার রামনগর-কলাবাড়ি গ্রামে মাঠে মাঠে কৃষকদের কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকে এসব কাজে ব্যস্ত দেখা গেছে। গোপালপুর গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা তামাকের বীজতলা পরিচর্যায় ব্যস্ত দেখা যায় অনেককেই। ক্ষেতের পাশেই ট্রাকে ভর্তি হচ্ছে ফুলকপি। গোটা এলাকায় কর্মমুখর পরিবেশ। তামাকের বীজতলার মালিকরা জানান, একহাজার তামাক চারা দু’শ থেকে তিন’শ টাকায় বেচাকেনা হয়ে থাকে। এবছরও তেমন দাম পাওয়া যাবে। কপি ক্ষেতের মালিক জানালেন ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি ফুলকপি আট টাকা দরে বিক্রি করছেন। ঢাকা থেকে ব্যাপারিরা এসে কপি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
লক্ষ্মীপুর ও গোপালপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়েক’শ বিঘা জলকর দলকা বিলের মুমূর্ষ অবস্থা চোখে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, এ বিল নিয়ে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের কারণে পানি প্রায় শূন্য হতে চলেছে। এ সুযোগে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা বিল কমিটির সেক্রেটারি পরিচয়দাতা লিটন প্রতিবিঘা জমি তিন থেকে চার হাজার টাকা দরে জমি চাষীদের কাছে ইজারা দিয়ে চলেছেন। ইজারা নেয়া চাষিরা সেখানে বিভিন্ন সবজি ও ফসলের আবাদ করছেন। এতে মৎস্যজীবীরা চরম বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে লক্ষ্মীপুর ও ভগিরথপুর গ্রামের মধ্যে যোগাযোগের জন্য মরাগাঙের ওপর স্থাপিত একমাত্র সেতুটি ভেঙে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী সেতুটির বড় ধরণের সংস্থার অথবা সেখানে নতুন করে সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। অবাক হলেও সত্য যে, ভগিরথপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মরাগাঙ দখল করে কয়েকজন দখলদার সেখানে ব্যক্তিগত পুকুর খনন করেছে। এভাবে একের পর এক পুকুর খনন করায় মরাগাঙের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে পড়েছে।
নতিপোতা ইউনিয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের ভেতরকার পরিবেশ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই। এলাকাবাসীরা জানান, কেন্দ্রের ভিজিটর বাছিরন বেগমের স্বামী বিল্লাল হোসেন গরু ও মোষের ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গরু-মোষ ওই কেন্দ্রের ভেতরে জড় করে রাখে। পরবর্তীতে তা গাড়িতে করে বিভিন্ন হাটে পাঠায়। সরেজমিন দেখা গেছে , ওই কেন্দ্রের ভেতরে স্থায়ী শেড করে এসব গরু-মোষ পালন ও মজুদ করা হয়ে থাকে। স্থানীয়রা জানান, অতি সম্প্রতি শাহারবানু (৭৫) নামে একজন বৃদ্ধা মহিলা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে এসে গরুর আঘাতে মারাক্তক আহত হন। যার কারণে পরিবারের সদস্যদেরকে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। স্থানীয়রা আরো জানান, বাছিরনের স্বামী নিজে একজন মাদকাসক্ত হওয়ায় ওই কেন্দ্রের ভেতরে প্রতিদিনই মাদকের আসর বসে। বিষয়টি নিয়ে এর আগে দামুড়হুদার ভারপ্রাপ্ত ইউএনওর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং অভিযোগের সত্যতা পান। তবে অভিযোগের বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি। এলাকাবাসী এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অবসান চায়।
এ বাজারে এক সময়ে অবস্থিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে অবাক করা তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় এক একর জমির ওপর অবস্থিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কক্ষটি বর্তমানে চক্রবাক সংঘ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার চারপাশে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করার পাশাপাশি ভবন তৈরি করে বসবাস করছেন অনেকেই। স্থানীয়রা জানান, এখানে খোঁজ নিলে কেঁচো খুড়তে সাপের সন্ধান মিলতে পারে।
নানা কারণে বহুল আলোচিত নতিপোতা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে দেখা গেলো সেখানে নিয়মিত ক্লাস চলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, লক্ষাধিক টাকা খরচে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তৈরি রেইন ওয়াটার হার্ভেষ্টিং সিস্টেম স্থাপনের পর থেকেই অচল। ছয়শতাধিক শিক্ষার্থীর নিরাপদ পানির অন্যতম এ মাধ্যমটি নষ্ট হলেও তা মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, অনৈতিক কাজের অভিযোগে বহিস্কৃত নয় ছাত্রছাত্রীর বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপাচাপি চলছে। পাশেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের সন্তোষজনক উপস্থিতি দেখা গেছে।
এ গ্রাম থেকে চারুলিয়া অভিমুখে যাওয়ার পথে দেখা গেলো বাইসাইকেলে বিশেষ কায়দায় ছাগল বহনের চিত্র। এলাকাবাসীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এসব ছাগল ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চারুলিয়া থেকে আটকবর হয়ে শিবনগর বটতলী বিলে দেখা গেলো মৎস্য উৎসব। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী অন্যান্য দিনের মতোই উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ ধরছেন।
শিবনগর থেকে চন্দ্রবাস হয়ে কানাইডাঙ্গা অভিমুখী সড়কের সম্প্রসারণের কাজ চলতে দেখা গেছে। তবে এ কাজ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের শেষ নেই। রাস্তা সম্প্রসারণের কাজে প্রয়োজনীয় খনন যেমন করা হয়নি, তেমনি নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে কাজ চলছে।
কার্পাসডাঙ্গা বাজারে দেখা গেলো হাইস্কুলের জমিতে নতুন করে বিশাল আকারে মার্কেট তৈরির কাজ চলছে। একই বাজারে পুলিশের তৈরি মার্কেটের আটটি দোকানঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে জমজমাট ব্যবসা চলছে। আবার কয়েকটি চালু করার প্রস্তুতি চলছে। ভৈরব নদের ব্রিজ পার হয়ে মুক্তারপুর গ্রাম। এ গ্রামে দেখা গেলো ভারত থেকে সীমান্ত পার হয়ে আসা মোষের সারি। দামুড়হুদা বাজারে দোকানঘর বন্ধ দেখা গেছে। তবে দামুড়হুদা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে বিতর্কিত মার্কেটের কাজ নির্মাণ শেষে প্রায় চালুর দিকে। স্থানীয়রা জানান, আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করেই এ মার্কেটের নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে হরতালের দিনে অন্যরক পরিবেশ দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট এলাকায়।