চলে গেলেন উপমাহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে

স্টাফ রিপোর্টার: আবার হবে তো দেখা….. ‘হাজার বার হাজারভাবে শোনা গান। কফি হাউজের সেই আড্ডাটা? লক্ষ্যকোটি স্রোতার হৃদয় ছোঁয়া গানগুলো থেকে যাবে, থাকলেন না উপমহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে।

‘এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো?’ ভাবনাটা এরকম- আবার দেখা হলে হতেও তো পারে! কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সবাই জেনে গেছে, এ গানের শিল্পী মান্না দে চলে গেছেন মায়াবী পৃথিবী ছেড়ে। তার সেই যাদুকরী কণ্ঠ আর কখনো সুরের মায়াজাল ছড়াবে না। যার গান শুনে শুনে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে- অতূলনীয় কণ্ঠের অধিকারী সেই শিল্পী আর নেই। তার সেই যাদু মাখানো কণ্ঠ থেমে গেছে চিরতরে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বেঙ্গালুরু হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে। বয়স হয়েছিলো ৯৪ বছর। শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না আগে থেকেই। গত ৮ জুন বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। স্ত্রী সুলোচনা কুমারণ মারা গেছেন গত বছর। স্ত্রীকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন মান্না দে। গতকাল তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। রেখে গেছেন দু কন্যা সুরমা আর সুমিতা এবং গোটা উপমহাদেশজুড়ে তার অগণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতা। গতকাল দুপুরে বেঙ্গালুরু হম্বাল মহাশ্মশানে তার মরদেহ দাহ করা হয়। এর আগে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ রাখা হয় শহরের রবীন্দ্র কলা কেন্দ্রে। অগণিত ভক্ত তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী মান্না দের মরদেহ কোলকাতায় নিয়ে আসার অনুরোধ জানালেও প্রয়াত শিল্পীর কন্যা সুমিতা সে অনুরোধ রাখেননি। তিনি জানান, বাবা চেয়েছিলেন, মায়ের মতো তাকেও যেন এ শ্মশানে দাহ করা হয়। সত্তর বছরের সঙ্গীত জীবনে তিনি বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় গেয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান। তিনি গেয়েছেন, ধ্রুপদী, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক, দ্বিজেন্দ্রগীতি, অতুল প্রসাদী, রজণীকান্তের গান, কীর্তন, লোকগীতিসহ নানা মেজাজের গান এবং সবই ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে তার কণ্ঠে। শৈশবে স্বপ্ন ছিলো কুস্তিগীর হওয়ার। সেটা যদি না হয় তবে ব্যারিস্টার বা অন্য কিছু। তবে সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার কোনো স্বপ্নই দেখতেন না তিনি। কোলকাতার ছেলে। সব কিছুতেই একটা সেয়ানা সেয়ানা ভাব আর ভারি ফুর্তিবাজ। দু মিনিটের মধ্যে যে কারো সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে জুড়ি ছিলো না। তবে কুস্তির প্যাচে ত্যাড়া লোকদের ‘টাইট’ করার একটা বড় সাধ ছিলো শৈশবে।

১৯১৯ সালের ১ মে কোলকাতার ৯ নম্বর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে তার যখন জন্ম হয়, বাবা পূর্ণ চন্দ্র দে আদর করে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখেন প্রবোধ চন্দ্র কিন্তু মা মহামায়া দেবী ছেলেকে অমন খটোমটো নামে ডাকতে চাইতেন না। তিনি তার এ ডাকাবুকো ছেলেটাকে বরাবরই ডাকতেন ‘মানা’ বলে। ডানপিঠে গোছের। পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলার দিকেই ঝোঁক। সুযোগ পেলেই পাড়ার আখড়ায় গিয়ে কুস্তির লড়াই দেখা ছিলো তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। ইন্দুবাবুর পাঠশালায় পড়ার সময় সহপাঠীদের কুস্তির দুই একটা প্যাঁচ কষেও দিতে ছাড়তেন না। এ নিয়ে কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি শিক্ষক ইন্দুবাবুকে। ইন্দুবাবুর পাঠশালা শেষ করার পর তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে। আর প্রবোধ চন্দ নিজের আগ্রহে সে আমলের বিখ্যাত কুস্তিগীর (লাইট হ্যাভিওয়েটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন) গোবর পালোয়ানের কাছে শিখতে লাগলেন কুস্তির নানা প্যাঁচ। ওদিকে অন্ধ গায়ক কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দের তখন সারা ভারতে নামডাক। তিনিই ভাইপোকে ধরে এনে বসিয়ে দিলেন তানপুরার সামনে। নিজেই সযত্নে তালিম দিতে লাগলেন। ব্যস, সঙ্গীত, লেখাপড়া আর কুস্তি চলতে লাগলো একই সাথে। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে প্রবোধ চন্দ্র ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগর কলেজে। সঙ্গীতে ভাইপোর প্রতিভা বুঝতে কষ্ট হয়নি কাকা কৃষ্ণ চন্দ্রের। তিনি তাকে তালিম নিতে পাঠালেন ওস্তাদ দবির খাঁর কাছে। কলেজে বন্ধুদের কাছেও গাইয়ে হিসেবে কদর বাড়তে লাগলো তার। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুরা এসে জেঁকে ধরত, ‘এই মানা, গা না একখানা প্লিজ!’ বেশি সাধাসাধির দরকার হতো না। টেবিল চাপড়ে শুরু হয়ে যেতো কে.এল. সায়গল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক বা তার কাকার গাওয়া বিখ্যাত সব গান। আস্তে আস্তে কলেজের শিক্ষকরাও জেনে গেলেন প্রবোধ চন্দ্রের গুণের কথা। কলেজ ফাংশন মানেই ‘মানা’।

মান্না দে দীর্ঘকাল শচীন কর্তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন শচীন দেব বর্মণের কথা। একই সাথে রসিক ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শচীন কর্তাকে ঘিরে মান্না দের স্মৃতিও অনেক। ‘জীবনের জলসা ঘরে’ তিনি লিখেছেন, ‘শুধু সঙ্গীত পরিচালনার কাজে নয়, বলতে গেলে তখন আমি সব কিছুতেই তার সহকারী। শচীন দা’র নির্দেশে গানের নোটেশন করি, ওঁর করা সুর শিল্পীদের গলায় তুলে দেই। শচীন দা চাইলে কলা এনে দেই, পান এনে দেই, ছোলা-বাদাম ভাজা এনে দেই। শচীন দা’র থলে বয়ে দেই। ‘তালাশ’ ছবিতে শচীন দা’র সেই বিখ্যাত সুর ‘তেরি নয়না তালাশ করকে’। গানটায় সুর করার পর শচীন দা বললেন, ‘মানা, তুই এইডা গাইবি।’ তিনি শেখাচ্ছেন আমাকে। এমন সময় ছবির প্রযোজক সেখানে এসে বললেন, ‘এ গান কি মান্না সাহাব গাইবে নাকি? মুকেশ কি হল?’ শচীন দা তার নিজস্ব স্টাইলে হিন্দিতে বললেন, ‘এ গান গাওয়ার সাধ্য মুকেশের নেই।’ পরিচালক বললেন, ‘তাহলে সে গান বানালেন কেন, যে গান মুকেশ গাইতে পারবে না!’ শচীন দা একেবারে অনড় ছিলেন। আমিই গাই গানখানি। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা।’

মান্না প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করলেন ১৯৫৩ সালে। ননফিল্মি মৌলিক গান- গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের কথায় আর নিজের সুরে। রেকর্ডের এক পিঠে ‘কতো দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং অন্য পিঠে ‘হায় হায়গো রাত যায় গো, দূরে দূরে রবে কি’। সে গান প্লাবনের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেলো বাঙালি শ্রোতাদের। এত বছর পরও এ গান দুটির আবেদন বাঙালি শ্রোতা হৃদয়ে আজো অমলিন। এরপর ১৯৫৬ সালে একই গীতিকারের কথায় ‘তুমি আর ডেকো না’ আর ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’। ১৯৫৭ সালে ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ ১৯৫৮ সালে ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিনু প্রদীপ আপন হাতে’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘এ জীবনে যতো ব্যথা পেয়েছি’, ‘আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ’। প্রতিটি গানই ইতিহাস গড়লো। রীতিমত মান্না ক্রেজ শুরু হয়ে গেলো বাংলায়। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। বাংলা চলচ্চিত্র বলতে তখন উত্তম কুমার সূচিত্রা সেনকেই বোঝাত। আর তাদের কণ্ঠে প্লেব্যাক মানেই হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। তবে মান্নার বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে শুরু করে টালিগঞ্জের নামকরা অভিনেতার লিপে একের পর এক বিস্ময় জাগানো গান গেয়ে চললেন তিনি। সারা জীবনে পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীসহ বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত করে। তবে এসব সম্মান ও পুরস্কার তার অবদানের তুলনায় নগন্য বলে মনে করেন অধিকাংশ সঙ্গীত বোদ্ধা। উপমহাদেশের সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী নামে পরিচিতি পাওয়া লতা মঙ্গেশকরও একই মত প্রকাশ করেছেন।

গতকাল থেকে মান্না দে নামের মানুষটা হয়ে গেলেন ইতিহাস। ঘরের দেয়ালে ফ্রেমে বাধানো কণ্ঠহীন গানের আদর্শ। নতুন কোন গান আর শোনা যাবে না তার কণ্ঠে। তবে তার গাওয়া ‘কফি হাউস, সে আমার ছোট বোন, কতো দূরে আর নিয়ে যাবে বল, আমি তার ঠিকানা রাখিনি, আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ, বাজে গো বীণা, ঝর ঝর বৃষ্টিতে থর থর দৃষ্টি, তুমি আর ডেকো না, কী দেখলে তুমি আমাতে, সেই তো আবার কাছে এলে, বড় একা লাগে, লাল মেহেদির নকশা হাতে, এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি, ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে, আমি যে জলসা ঘরে- এমনি বহু বাংলা গান অথবা তার কণ্ঠের রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, হিন্দি অথবা রাগাশ্রয়ী গানগুলো উপমহাদেশের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াবে যুগের পর যুগ।