স্টাফ রিপোর্টার: গত সাড়ে চার বছরে নবম জাতীয় সংসদে ২৩৯টি আইন পাস হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮টি আইন পাস হয়েছে সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে, বিরোধী দলের সাথে আলোচনা ছাড়াই। ফলে এসব বিল পাস হয়েছে দ্রুততার সাথে। সংসদের কার্যপ্রবাহ থেকে জানা যায়, অনেক সময়ই যথাযথ বিতর্ক এবং আলোচনা ছাড়াই সংসদের বিল পাস হয়। এর কারণ বিরোধী দলের অনুপস্থিতি। বিরোধী দলীয় জোটের উপস্থিতিতে যেসব বিল পাস হয়েছে, সে সময়ে তুমুল বিতর্কে সংসদ ছিলো প্রাণবন্ত। যে কারণে প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টারও বেশি। এসব বিলে বিরোধীদলের সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করার নজিরও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রস্তাব গ্রহণ হয়েছে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমের। এর বাইরে বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এবং রাশেদা বেগমের প্রস্তাব গ্রহণ হয়েছে।
বর্তমান সংসদে এ পর্যন্ত গত সাতটি অধিবেশনে ২৩৯টি বিল পাস হলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের জোটের সদস্যরা মাত্র ৪১টি বিল পাস হওয়ার সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন। বাকি ১৯৮টি বিল পাস হওয়ার সময় তারা সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। যে কারণে এসব বিল সংক্রান্ত বিরোধীদলীয় সদস্যদের নোটিসও উত্থাপিত হয়নি। আবার এমনও দেখা গেছে, দল সংসদে থাকলেও নোটিসদাতা উপস্থিত ছিলেন না। ফলে এসব বিলের উপর সংসদে তেমন কোন আলোচনা হয়নি। বিরোধীদলের দেয়া নোটিসের ৯০ ভাগই উত্থাপিত হয়নি অনুপস্থিতির কারণে।
বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং নোটিস না থাকায় বর্তমান সংসদে কোনো রকম বিতর্ক ছাড়াই ৯০টির মতো বিল পাস হয়েছে। বিলের দফা উচ্চারণ করতে স্পিকারের যেটুকু সময়ের প্রয়োজন, সেই সময়ের মধ্যে এসব বিল পাস হয়েছে। প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লেগেছে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। তবে অনেক বিলে মহাজোটের সদস্যরাও সংশোধনী এবং জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেয়ায় বিলগুলো পাস হতে একটু বেশি সময় লেগেছে।
বিরোধী দলের সংসদে এ হতাশাজনক উপস্থিতি আর একতরফা সরকারি দলের সদস্যদের নিয়ে বিল পাসের মধ্য দিয়েই নবম জাতীয় সংসদের সম্ভাব্য শেষ অধিবেশন এখন চলছে। আজ সোমবার বিকেল পাঁচটায় মুলতবি অধিবেশন আবার শুরু হবে। আর কাল অধিবেশন শুরুর সাথে সাথেই নবম জাতীয় সংসদ ৪০১ কার্যদিবসে পা রাখবে। আর সেই সাথে সবচেয়ে বেশি দিন অধিবেশন চলার রেকর্ড স্পর্শ করবে এ সংসদ। এর আগে ৫ম জাতীয় সংসদ সর্বাধিক ৪০০ দিন অধিবেশন চলছিলো।
সংসদ অধিবেশন বেশি কার্যদিবস চলার রেকর্ডের পাশাপাশি বিরোধী দলের সদস্যদের সংসদ বর্জনের রেকর্ডও বেড়েছে। ফলে ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুই ধরনের রেকর্ডই থাকছে এ সংসদের নামের পাশে। চলতি অধিবেশনের গত কার্যদিবস পর্যন্ত ৪০০ দিনের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মাত্র ৫৬ দিন সংসদে উপস্থিত ছিল। চলতি অধিবেশনের প্রথম ৬ দিন পার হলেও এখন তারা সংসদে ফেরেনি।
ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বলেন, বিরোধীদল সংসদে থাকলে সংসদ আরো প্রাণবন্ত ও কার্যকর হতো এটা ঠিক। কিন্তু বিরোধী দল সংসদে না এলেও তারা সংসদীয় কমিটির সভায় নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলগুলো প্রস্তুত করছেন। অধিবেশন কক্ষে তারা উপস্থিত না থাকলেও প্রশ্ন জমা দিচ্ছেন এবং সংসদে মন্ত্রীরা তার জবাব দিচ্ছেন। সকলের আগ্রহের কারণেই এ সংসদ সবচেয়ে বেশি দিন চলার রেকর্ড করছে।
বিরোধী দলের উপস্থিতি কম: সংসদ নিয়ে বিরোধী দলের আগ্রহ এতই কম যে গত সাড়ে চার বছরেও তারা বিরোধী দলের উপনেতা নির্বাচন করেনি। এ আসনটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনুপস্থিতিতে বিকল্প নেতা থাকে না। বিরোধী দলের নেত্রীর উপস্থিতি আরও হতাশাজনক। নবম জাতীয় সংসদের এই পর্যন্ত অতিবাহিত ৪০০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপিসহ চারদলীয় জোট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা গড়ে উপস্থিত ছিলেন ৫৬ দিন। অবশিষ্ট ৩৪৬ দিনই তারা সংসদে যোগ দেননি। যদিও সতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম এবং মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদে নিয়মিত যোগ দেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) অলি আহমেদ সংসদের প্রথম দুই বছর নিয়মিত থাকলেও এখন তিনিও অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন।
বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, আমরা তো সংসদে যাওয়ার ও সংসদ কার্যকর করার পক্ষে। কিন্তু সরকারি দলের ব্যর্থতার কারণে সেটি না হলে এর দায়ভার সরকার পক্ষেরই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংসদের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, বিরোধী দল ছোট হলেও তাদের ছাড়া সংসদ কার্যকর বলা কঠিন। বিরোধী দলকে সংসদে যাওয়া প্রয়োজন জনগণের স্বার্থেই।
রেকর্ড আর রেকর্ড: সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদে অনুপস্থিতির আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে বিএনপি। বর্তমান সংসদের সর্বশেষ হিসেব অনুসারে ৪০০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপির সদস্যরা গড়ে ৫৬ দিন উপস্থিত ছিলেন। আর এসময় বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মাত্র ৮ দিন উপস্থিত ছিলেন।
আর কার্যদিবসের হিসেবে ৪০০ দিন পার করে নবম জাতীয় সংসদ রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। এর আগে অষ্টম সংসদ ৩৭৩ কার্যদিবস, ৭ম জাতীয় সংসদ ৩৮২ কার্যদিবস এবং ৫ম জাতীয় সংসদ ৪০০ দিন চলেছিল।
সংসদ বর্জনের চিত্র: বিরোধীদলের সংসদ বর্জন বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে অনেকটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত চারটি সংসদেই ক্রমশই এ বর্জনের হার বাড়ছে। তবে এবারের মত রেকর্ড আর হয়নি বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে। সংসদ মেয়াদ শেষে এ রেকর্ড আরও বাড়বে। বিগত অষ্টম জাতীয় সংসদের ৫ বছরে ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বর্জন করে ২২৩ দিন। অর্থ্যাত্ ওই সংসদে তারা ১৫০ দিন উপস্থিত ছিলেন। তাদের গড় উপস্থিতি ছিলো ৪২ শতাংশ।
৭ম জাতীয় সংসদের ৫ বছরে মোট কার্যদিবস ছিলো ৩৮২ দিন। বিরোধী দল বিএনপি বর্জন করে ১৬৩ দিন। আর উপস্থিত ছিলেন ২১৯ দিন। বিরোধী দলের গড় উপস্থিতি ছিল শতকরা ৫৭ ভাগ। ৫ম জাতীয় সংসদের ৫ বছরে মোট কার্যদিবস ছিল ৪০০ দিন। বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বর্জন করে ১৩৫ দিন। আর উপস্থিত ছিলো ২৬৫ দিন। বিরোধী দলের গড় উপস্থিতি ছিলো শতকরা ৬৬ ভাগ।