মেহেরপুর বিসিকে পাম ফল থেকে তেল উৎপাদন শুরু

সবুজ গাছে তরল সোনা : বদলে দেবে বাংলাদেশ

 

মাজেদুল হক মানিক: তেল উৎপাদনের কোনো মাধ্যম না থাকায় চাষিদের গলায় কাটা হয়ে বিঁধেছিলো পামগাছ। দীর্ঘদিন পরিচর্যার পর সোনালি স্বপ্ন নিয়ে পামগাছে আসা কাঙ্ক্ষিত ফল কোনো কাজেই আসছিলো না চাষিদের। ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েকজন যুবক মেহেরপুর বিসিক শিল্পনগরীতে স্থাপন করেছেন দেশের একমাত্র পাম তেল উৎপাদন কারখানা। শুধু তেল উৎপাদনই নয়, পাম চাষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও দিচ্ছেন এ যুবকরা। হতাশার সাগরে ডোবা চাষিদের আশার আলো দেখাচ্ছেন এই যুবকেরা। পাম তেলকে সবুজ গাছের তরল সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তারা।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৯ সালের শেষের দিকে একটি এনজিও (গ্রিন বাংলাদেশ) মেহেরপুর জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পামগাছের চারা বিক্রি করে। লাভজনক ফসল ও চাষের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষিরা পাম বাগান গড়ে তোলে। বাড়ির আঙিনাসহ পতিত জমিতেও পামগাছ লাগানো হয়। ২০১১ সালের মার্চ মাসের দিকে ওই এনজিও হঠাৎ কার্যক্রম গুটিয়ে কর্মকর্তরা আত্মগোপন করেন। বিপাকে পড়েন পামগাছ চাষিরা। গাছে ফল ধরা শুরু হলেও তা ঝড়ে পড়ছিলো। আবার দুয়েকটি ক্ষেতে ফল এলেও তা বিক্রি ও তেল তৈরির কোনো উৎস না থাকায় চরম হতাশায় ভুগছিলেন চাষিরা। অনেকেই গাছ কেটে অন্য ফসল করেছেন। চাষিদের এই দুঃসময়ের কান্ডারি হয়ে হাজির হন ২০০৫ সালে গাজীপুর এগ্রিকালচার ইন্সিটিউট থেকে কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করা মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের সুরুজ আলী। সুরুজের সাথে যোগ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন কৃষি ডিপ্লোমাধারী যুবক ও ব্যবসায়ী। এদের সাথে রয়েছেন অবসারপ্রাপ্ত কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা। বোটানিক এগ্রো লিমিটেড নামে একটি ফার্ম গঠন করেছেন যার প্রধান কার্যালয় মেহেরপুর কলেজ রোডে। এখন পামগাছ চাষিদের আশার আলো দেখাচ্ছেন তারা।

শুরুর কথা:               সুরুজ আলী জানালেন, আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া পামচাষের উপযোগী। তবে চাষের কলা-কৌশল না জানা এবং সঠিক পরিচর্যার অভাবে ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তারা পামচাষিদের পরামর্শ দেয়া শুরু করেন। বিশ্বের বৃহৎ পাম উৎপাদনশীল দেশ মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে পামচাষের অতীব প্রয়োজনীয় হরমন ও কীটনাশক। যা প্রয়োগ করে পামগাছে কাঙ্ক্ষিত ফল আসতে শুরু করেছে। চাষের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। পাম চাষের প্রয়োজনীয় কীটনাশক, হরমন, সার ও তেল উৎপাদন কারখানা মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বোটানিক এগ্রো লিমিটেড। সময়ের প্রয়োজনে এ বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে জানালেন এর কর্মকর্তারা।

পাম তেল উৎপাদন কারখানা: দেশে পাম তেল উৎপাদনের কোনো যন্ত্র না থাকায় পাম চাষ সম্প্রসারণ সবচেয়ে চড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। বোটানিক এগ্রো লিমিটেডের কার্যক্রম শুরু হলে পাম তেল উৎপাদন কারখানা স্থাপনের প্রাথমিক কাজও শুরু হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা সম্ভব হচ্ছিলো না। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে ঢাকার সানটেক এজেনসিস অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন ও ব্রয়লার এক্সপার্ট হাসান আলীর তত্ত্বাবধানে যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ শুরু হয়। জার্মানের একজন প্রকৌশলীর সহযোগিতায় তারা তৈরি করেন পাম তেল উৎপাদন মেশিন। সুরুজ আলী বললেন, ফলের খোসা ও বীজ থেকে আলাদা তেল উৎপাদনের জন্য প্রকৌশলীদের কাছে তাদের চাহিদার কথা বলা হয়। সে মতে তারা তৈরি করেছেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে মেহেরপুর বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানায় যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্পন্ন হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এখন তেল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এখানে সংক্রিয় ব্রয়লার মেশিনে বীজ সিদ্ধ করে তা আরেকটি হুইলারে দিয়ে খোসা ও বীজ আলাদ করা হয়। বীজ ও খোসা আলাদা কম্প্রেসার মেশিনে চেপে তেল বের হয়। প্রতি ঘণ্টায় এক টন (এক হাজার কেজি) পাম ফল থেকে তেল উৎপাদন করতে পারছে এই কারখানায়।

চাষিদের উৎসাহ: দেশের কোনো অঞ্চলে পাম চাষিদের দূরবস্থার কথা শুনলেই সেখানে ছুটে যাচ্ছেন বোটানিক এগ্রো লিমিটেডের কর্মকর্তারা। গাছ না কেটে পরিচর্যার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বোটানিক এগ্রোর কর্মকর্তারা জানালেন, চাষিদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের ক্ষেত থেকে ফল সংগ্রহ করে তেল উৎপাদন করে দেখানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানের চাষিদের দু টন মতো ফল সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো এনে চাষিদের সামনেই তেল তৈরি করা হচ্ছে। ভোজ্য তেল চাষিদের খাওয়ার জন্য দেয়া হয়েছে। এতে চাষিদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। তারা এখন পাম চাষের মনোনীবেশ করেছেন। তবে কারখানাটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হয়নি পর্যাপ্ত ফলের অভাবে। ঝিনাইদহ, যশোর, পাবনা, মাদারীপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার চাষিদের ক্ষেত পরিচর্যা করা হচ্ছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১০/১২ টন ফল পাওয়ার আশা রয়েছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কারখানার চাহিদা অনুযায়ী পাম ফল পাওয়ার আশা করছেন তারা। আর তখনই কারখানাটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন কর্মকর্তারা। চাষিরা চাইলে নগদ টাকায় ফল বিক্রি করতে পারেন নয়তো তেল তৈরি করেও নিতে পারবেন।

উদ্যোক্তরা জানিয়েছেন, জেলার ছোট বড় ১২৫টি বাগান এবং প্রায় ১২ হাজার পাম গাছ রয়েছে। গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের চাষি হাজি ইছাহাক আলীর দু বিঘা জমিতে রয়েছে ৮৫টি পাম গাছ। সুরুজ ও তার টিমের তত্ত্বাবধানে এখন ফলন শুরু হয়েছে বলে জানালেন এই চাষি। তার ক্ষেতের ৫০ কেজি ফল থেকে চলতি মাসের শুরুর দিকে ওই কারখানায় নিয়ে তেল তৈরি করা হয়েছে। ক্ষেতে যেভাবে ফল এসেছে তাতে অনেক লাভের আশা করছেন ইছাহাক আলী।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাম চাষে উদ্বুদ্ধ করছে বলে জানালেন উপপরিচালক শেখ ইখতেখার হোসেন। তেল উৎপাদন কারখানাটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষকসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে বলে আশা করছেন এ কৃষি কর্মকর্তা।

বোটানিক এগ্রো লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, সবুজ গাছে তরল সোনা বদলে দেবে বাংলাদেশ’ এ স্লোগানে সারাদেশে কাজ করছি। পাম থেকে শুধু ভোজ্য তেলই নয় কসমেটিক তৈরির উপকরণ, গাছের ডাল থেকে উন্নত পারটেক্স ও  ভেষজ উপাদন তৈরি সম্ভব। দেশে প্রতি বছর ৫২ হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল আমদানি করা লাগে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাম তেল উৎপাদন করা গেলে আমদানি কমিয়ে দেশের অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা যেতে পারে বলে জানালেন পাম চাষিসহ সংশ্লিষ্টরা।

1 comment

  1. আসসালামু আলাইকুম,
    আমি বোটানিক এগ্রো লিমিটেড
    এর চেয়ারম্যান জনাব হাবিবুর রহমানের
    মোবাইল নম্বর চাচ্ছি। প্লিজ দেওয়া যাবে কি? আমার নম্বর ০১৭১১৯২৯৪৫৫
    মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

Comments are closed.