প্রতিহিংসার শিকার যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা খুন

পরিষদের পাশে প্রকাশ্যে ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু খুন

চৌগাছার শামীম ও তার ভগ্নিপতি ১২ হত্যা মামলার পলাতক আসামি নান্নু?

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, চৌগাছার সিংহঝুলি ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান মিন্টু খুন হয়েছেন। গতকাল বেলা তিনটার দিকে দুর্বৃত্তরা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই তাকে গুলি করে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী খুনি চক্রের দুজনকে চিনে ফেলে। তবে তারা মুখ খুললে তাদেরকেও হত্যার হুমকি দিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে খুনিরা এলাকা ত্যাগ করে।

হত্যা মিশনে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন অংশ নেয়। খুনিরা সকলেই হেলমেট পরে ছিলো। চৌগাছার সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান শামীম ও তার ভগ্নিপতি ১২ হত্যা মামলার পলাতক আসামি নান্নু এ হত্যা মিশনের নেতৃত্ব দেয় বলে নিহতের স্বজনরা দাবি করেছেন। হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে যশোর জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান ও পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র ঘটনাস্থলে যান এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলেন। এ হত্যাকাণ্ডে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোকাহত মানুষ যশোর-চৌগাছা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সিংহঝুলি বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হত্যা কানেকশনে জড়িতদের আটকে ডিবি পুলিশ বিকেল থেকেই শুরু করেছে কম্বিং অপারেশন। এদিকে জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ যশোর শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে খুনিদের অবিলম্বে আটকের দাবি জানিয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে আজ চৌগাছায় হরতাল ডেকেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী যশোর জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তজিবর রহমান জানান, গতকাল দুপুরে স্থানীয় শহীদ মসিয়ূর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সকল সদস্য ও শিক্ষকদের খাওয়া-দাওয়া চলছিলো। সিংহঝুলি ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টুও ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলীকদর সামসুজ্জামান, অ্যাড. তজিবর রহমান ও জিল্লুর রহমান মিন্টু প্রধান শিক্ষকের রুমের সামনের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। এক পর্যায়ে মিন্টু বারান্দা থেকে নেমে ১০ হাত দূরে স্কুলের সামনে একটি খেজুর গাছের নিচে গিয়ে বসেন। এ সময় মাথায় হেলমেট হাতে শটগান নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে খুনি চক্রের ২ সদস্য। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুনিদের একজন বলে ওঠেন ওই তো শুয়োরের বাচ্চা। মুখের কথা শেষ হতে না হতেই মিন্টু বলে ওঠেন এই তোরা কি করছিস। সাথে সাথে হাতের শটগান উঁচিয়ে খুনিরা মিন্টুর মাথা ও বুকে তিন রাউন্ড গুলি করে। মুহূর্তে মিন্টুর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন অ্যাড. তজিবর বারান্দা থেকে নামতে উদ্ধত হলে খুনিরা তাকে শাসিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। তজিবর বলেন, খুনিরা মাথায় হেলমেট পরে থাকায় তাৎক্ষণিক তাদের চেনা সম্ভব হয়নি। তবে এ মিশনে খুনিরা একাধিক ব্যক্তি ছিলো বলে তিনি পরে জানতে পেরেছেন।

চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম রহমান জানান, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। খুনের ঘটনার আগে খুনিরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে অবস্থান নেয়। পরে খাওয়া শেষ করে মিন্টু ঘরের বাইরে আসার সাথে সাথে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ওসি গোলাম রহমান বলেন, খুনিরা  তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয়জন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এর মধ্যে দুটি মোটরসাইকেলে বসে চারজন মুসিয়ূর রহমান স্কুলের পূর্ব দিকের স্বাধীনতা সড়কে অবস্থান নেয়। বাকি দুজন স্কুলের পূর্ব পাশ দিয়ে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে। হেলমেট পরা অবস্থায় খুনিদের একজন শটগান  ও অন্যজন রিভলবার ঠেকিয়ে মিন্টুকে গুলি করে হত্যা মিশন সাকসেস করে। ঘটনার পর খুনিরা বীরদর্পে ওই তিনটি মোটরসাইকেলে চেপে মুক্তিনগরের দিকে চলে যায়। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি খুনিদের চলাচল প্রত্যক্ষ করেছে।

গোপন বৈঠক: নিহত জিল্লুর রহমান মিন্টুর স্বজনরা গতকাল সাংবাদিকদের জানান, এই হত্যাকাণ্ডে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা জড়িত। বুধবার রাতে ওই নেতার নির্দেশে উপজেলার অপর এক নেতার অফিসে একটি গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয় কিলিং পরিকল্পনা। পরিকল্পনা মোতাবেক কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৬ জন। এদের মধ্যে চৌগাছার একাধিক হত্যাকাণ্ডের নায়ক শিশু সৌরভ হত্যার অন্যতম ঘাতক শামীম ও তার ভগ্নিপতি নান্নু ওই মিশনের নেতৃত্ব দেন। সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের আগে বেলা ১২টার দিকে সলুয়া বাজার সংলগ্ন একটি মোড়ে একজন আওয়ামী লীগ নেতার ব্যক্তিগত অফিসে খুনিরা একত্রিত হন। পরিকল্পনা মোতাবেক খুনিরা ওই নেতার শেখানো পথে সিংহঝুলি ইউনিয়ন  পরিষদ চত্বরে যায় এবং মিন্টুকে খোঁজ করে। পরে  সন্ত্রাসীরা সন্ধান পেয়ে পাশের হাইস্কুল মাঠে বসে থাকা মিন্টুকে গুলি করে হত্যা করে।

কেন এই হত্যাকাণ্ড? জিল্লুর রহমান মিন্টু দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে মিন্টু গত ইউপি নির্বাচনে সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার সাথে মিন্টুর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। বিতর্কিত ওই আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টুর বিপক্ষে স্থানীয় এক চোরাচালানীকে প্রার্থী করেন। নির্বাচনে মিন্টু বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর মিন্টু সিংহঝুলিসহ গোটা উপজেলাকে মাদকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। যা নিয়ে ওই শীর্ষ নেতার গাত্রদাহ শুরু হয়। জনহিতকর নানা কর্মকাণ্ডের ফলে মিন্টুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। সম্প্রতি মিন্টু  আগামীতে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ওই বিতর্কিত নেতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এর আগেই একই ধরনের ইচ্ছা পোষণ করায় খুন হন পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল ও সিংহঝুলি ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান আশাকে হত্যা করা হয়। সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে অতীতের সকল হত্যাকাণ্ডের সাথে মিন্টু হত্যার মিল রয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। ফলে এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আওয়ামী লীগের ওই শীর্ষ নেতা জড়িত বলে এলাকাবাসীর ধারণা।

মায়ের আকুতি এ হত্যাকাণ্ডে এসএম হাবিব জড়িত: জিল্লুর রহমান মিন্টুর বৃদ্ধ মায়ের আকুতি থামছে না। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের জন্য চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম হাবিব ও তার বাহিনীর ক্যাডারদের দায়ী করেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বৃদ্ধা বলেন, এসএম হাবিবের সব অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ করায় সে তার ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে আমার বুকের মানিককে হত্যা করেছে। ওই শামীম আর নান্নু আমার সোনারে খুন করেছে। আমি এদের ফাঁসি চাই। তিনি অবিলম্বে এসব খুনি চক্রকে আটকের জন্য এসপি ও জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি জানান।

আজ চৌগাছায় হরতাল: ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান মিন্টু হত্যার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার চৌগাছা বাজারে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি শাহজাহান কবীর বলেন, খুনিদের আটক ও বিচারের দাবিতে এ হরতাল পালিত হবে। হরতাল চলার সময় বাজারের সব দোকান প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সাপ্তাহিক বাজারের দিন হওয়া সত্ত্বেও সবকিছু বন্ধ রেখে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হবে। তাৎক্ষণিক দলের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে ওই বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক এসএম হাবিব ছিলেন না।