স্টাফ রিপোর্টার: অ্যানার্জি ড্রিংক নামে মানুষ যা খাচ্ছে তা কতোটুকু স্বাস্থ্যকর? যারা বাজার থেকে এসব অ্যানার্জি ড্রিংক পান করছেন তারা হয়তো ভাবছেন যেহেতু এ ধরনের পণ্যের মান তদারক করছে সরকারি সংস্থা বিএসটিআই সেহেতু দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কয়েকটি অ্যানার্জি ড্রিংকে বিপজ্জনক মাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ সোডিয়াম বেনজয়েটসহ ভয়ঙ্কর মাদক আফিমের উপস্থিতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এ বিষয়ে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, কোমলপানীয় পান করলে কিডনি বিকল হতে পারে, নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংক নামের একটি কোমল পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম বেনজয়েট মেশানো। এটি এক ধরনের প্রিজারভেটিভ। বিএসটিআই কর্তৃক নির্ধারিত মান (বিডিএস) অনুযায়ী সোডিয়াম বেনজয়েট প্রতি লিটারে ১৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এই মাত্রা অতিক্রম করলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এদিকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংকসহ বাজারে প্রচলিত কয়েকটি কোমল পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম বেনজয়েট মেশানো হচ্ছে। এ তথ্য যাচাই করার জন্য সম্প্রতি রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংকের একটি নমুনা সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে আসে। এতে দেখা যায়, প্রতি লিটার রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংকে সোডিয়াম বেনজয়েট থাকে ২১৩ মিলিগ্রাম। এরপর এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন ও খ্যাতিমান চিকিৎসক অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, সোডিয়াম বেনজয়েট উচ্চমাত্রায় গ্রহণ করলে মানুষের পরিপাকতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া কিডনি অকেজো হওয়া, আলসার হওয়া বা গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত বা অটিস্টিক শিশু জন্মের আশঙ্কা রয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ তালুকদার বলেন, সোডিয়াম বেনজয়েট এক ধরনের প্রিজারভেটিভ যা মানবদেহে খাদ্য হজমে সহায়তাকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে দেয়। ফলে হজমের সমস্যা হয়। এক পর্যায়ে কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হয়।
ব্র্যান্ডটি কেন প্রিয়: বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের যতোগুলো অ্যানার্জি ড্রিংক রয়েছে, তার মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংকের রমরমা চাহিদা লক্ষণীয়। এর কারণ জানতে পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাজার ঘুরে অনুসন্ধান চালানো হয়। এই অনুসন্ধানে ক্রেতা বিক্রেতাদের সাথে কথা বললে এর আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। রাজধানীর গাবতলী টার্মিনালে অবস্থিত অনেক মুদি দোকানদারদের মধ্যে কয়েকজনের কাছে কোনো ব্র্যান্ডের অ্যানার্জি ড্রিংক বেশি বিক্রি হয় জানতে চাওয়া হলে তারা এক বাক্যে জানান, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংক। সকালে এক কার্টন আনলে বিকালেই শেষ হয়ে যায়। এতো চাহিদার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, ভাই, এর বেশিরভাগ কাস্টমার ইয়ং পোলাপান। এডা খাইলে নাকি তাদের শরীর চাঙ্গা হয়, ফিলিংস আসে। জানিনা এডার ভিতরে কি আছে। মাঝে মধ্যে আমরাও খাই। খাওয়ার পর কেমন জানি নেশা নেশা লাগে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মুদি দোকানি ফয়সাল আলম বলেন, বাজারে টাইগার আসার পর অন্যান্য ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়র বাজার কিছুটা পড়ে গেছে। সবাই শুধু টাইগার চায়।
এদিকে দোকানদারদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে দেখা গেল কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক এসে ঠিকই অ্যানার্জি ড্রিংক কিনলেন। দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে তারা যখন এই কোমল পানীয় পান করছিলেন তখন তাদের সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ভাই, টাইগার এক আজব জিনিস। এটি খাইলে দারুণ ফিলিংস হয়। গাড়ি যতো জোরে চলে ততোই ফুর্তি ফুর্তি লাগে।
ফিলিংসের কারণ: অ্যানার্জি ড্রিংক মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিএসটিআই’র একজন কর্মকর্তা জানান, রয়েল টাইগার অ্যানার্জি ড্রিংকে উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন রয়েছে। ক্যাফেইন একটি উত্তেজক রাসায়নিক। মাদক শ্রেণীভুক্ত ১১টি উপাদানের অন্যতম এ ক্যাফেইন। তাই ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করলে এক ধরনের নেশা নেশা ভাব হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসক ড. আকতারুজ্জামান সেলিম বলেন, ১২ বছরের নিচে কেউ উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন মেশানো পানীয় পান করলে তার সারারাত ঘুম হবে না। দীর্ঘদিন এ ধরনের পানীয় পান করতে থাকলে তার ক্যাফেইন আসক্তি দেখা দেবে। তার স্বাভাবিক জীবনযাপনও বিঘ্নিত হবে। এক পর্যায়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে। তবে বিএসটিআইর সূত্র জানিয়েছে, অ্যানার্জি ড্রিংক তথা কার্বনেটেড বেভারেজে ক্যাফেইনের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বিডিএস ১১২৩ অনুযায়ী কোনোভাবেই এটি প্রতি লিটারে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি মেশানো যাবে না। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ক্যাফেইনকে কালো তালিকাভুক্ত করায় বিএসটিআই কার্বনেটেড বেভারেজে ক্যাফেইনের মাত্রা কমিয়ে ১৪৫ মিলিগ্রামে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএসটিআইর পরিচালক (মান) ড. সৈয়দ হুমায়ুন কবির বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ক্যাফেইনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ১৩০ থেকে ১৪৫ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কার্বনেটেড বেভারেজে ক্যাফেইনের মাত্রা ১৪৫ এবং ইউরোপে এটির মাত্রা ১৩০-এর বেশি নয়। কিন্তু ক্যাফেইনের মাত্রা কমানোর এ প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে কার্বনেটেড বেভারেজ উৎপাদনকারীরা। তারা আরও বেশি মাত্রায় ক্যাফেইন মেশানোর পক্ষে বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে বিএসটিআই’র ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।