ফুটফুটে মেয়ে রিয়া। বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিলো। শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ যানবহানের ধাক্কায় তার তরতাজা প্রাণ ঝরে গেলো। শিশু রিয়ার এ অকাল মৃত্যুর দায় কার? এলাকার সাধারণ মানুষের নাকি প্রশাসনের? সরকার যে যানবহনকে বৈধতা দেয়নি, অবৈধ ঘোষণা করে সড়ক থেকে উচ্ছেদের নিদের্শনা দিয়ে পরিপত্র জারি করেছে, সরকারের সেই নির্দেশ কেন বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না? জবাব যাই থাকুক, আইন প্রয়োগে নিয়োজিতদের নমনীয়তার খেসারত সমাজকেই দিতে হচ্ছে। বাড়ছে হতাশা।
শ্যালোইঞ্জিনচালিত হরেক নামের অবৈধযান অবশ্যই অসংখ্য পরিবারে সচ্ছলতা এনেছে। তবে যতোটা পরিবারে সচ্ছলতা এনেছে তার চেয়ে ঢের বেশি পরিবারে পঙ্গুত্বের বোঝা চাপিয়েছে। কর্মক্ষম বহু পুরুষকে কেড়ে নিয়ে অসংখ্য পরিবারকে পথে বসিয়েছে। সড়ক হয়েছে মৃত্যুপুরি। এরপরও প্রশাসনের ঘোর কাটেনি, কাটছে না। অবাক হলেও সত্য যে, অবৈধযান সড়ক থেকে উচ্ছেদ তো হচ্ছেই না, এসব যান তৈরির কারখানাগুলোতে প্রকাশ্যেই দেদারছে তৈরির কাজ চলছে। যে ইঞ্জিন মূলত কৃষি সেচের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য যে ইঞ্জিনের জন্য শুল্ক ছাড় দেয়া হয়, সেই ইঞ্জিনের নানাবিধ ব্যবহার আর্থসামাজিক উন্নয়নের বদলে পদে পদে যখন ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমদানি এবং বিক্রিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা বহুলাংশে কল্যাণ বয়ে আনতে পারতো। এটা যেমন অদূরদর্শিতারই কুফল, তেমনই ওই যানবাহন রাস্তায় চলাচলের শুরুতেই সরকার অবৈধ ঘোষণা করে তা উচ্ছেদে কড়াকড়ি আরোপ করলে কিছুটা সুফল মিলতো। শুরুতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশংসা করে পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন অবৈধ ঘোষণা করে সড়ক থেকে উচ্ছেদে জারি করা হয়েছে পরিপত্র। এ পরিপত্রের নিদের্শনা অনুসরণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের টাকায় কেনা ওইসব যানবাহন চালিয়ে সচ্ছলতা ফেরানোসহ যোগাযোগ সহজতর ধরণ দেখে নমনীয়তা ভর করেছে। তারই কুফল পড়ছে গোটা সমাজে। দিনের পর দিন নমনীয়তার সুযোগে সড়কে অবৈধযানের অধিকাংশ এখন এতোটাই যে, তা পূর্ণাঙ্গভাবে উচ্ছেদ প্রায় অসম্ভব। তাহলে এখন কী হবে? সড়ক কি তাহলে মৃত্যুপুরিই থাকবে? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা কি আমাদের দেশে কোনো দিনই মেলবে না?
নানামুখি ব্যর্থতার মূলে মূলত অদূরদর্শিতা। অবৈধযানের আধিক্য রোধে কারখানাগুলোর দিকে কড়া নজরদারি এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে নমনীয়তা পরিহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যাত্রীবহনের মতো নিরাপদ করতে না পারলে যাত্রীবহন করলেই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চালক? অপ্রাপ্ত বয়সের চালক দেখলেই অবৈধযান রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি তার অভিভাবকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অদক্ষতা দূর করতে দুর্ঘটনা ঘটলেই উপযুক্ত শাস্তির লক্ষ্যে আইন প্রয়োগে আন্তরিক হতে হবে। রাতে অবৈধযানের প্রধান দুটি লাইটসহ পাশে ও পেছনে বিশেষ বাতির ব্যবস্থা না দেখলে তা বাজেয়াপ্ত করার মতো কঠোর মনোভাব নিয়েই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আটক আর ছাড়ার নাটক বন্ধ করতে না পারলে উৎকোচের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবে না পুলিশ। মাসোহারা নিয়ে সড়কে অবাধে চলাচলের সুযোগ দিয়ে তার দায়ভার রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপালেও নীরবতা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া নয় কি? অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে, দূর করতে হবে অনিয়ম। তবেই না সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখা যাবে। প্রজন্ম পাবে বাসযোগ্য দেশ।
স্কুলছাত্রী রিয়ার মৃত্যুর জন্য শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধযানের পাশাপাশি স্থানীয়রা আরো একটি বিষয়কে দায়ী করেছেন। তা হলো- রাস্তার পাশে গরু বাধাকে। একদিকে বাধা গরু, অন্য দিকে দানবরুপি ঘাতক যান। প্রাণ ঝরেছে শিশু রিয়ার। গ্রামবাংলায় রাস্তার পাশে শুধু গরুই বাধা হয় না, রাস্তার ওপর ভুট্টাসহ নানা প্রকারের কৃষিপণ্য রেখে শুকানো হয়। কৃষিপ্রধান দেশে স্থান না পেয়ে কৃষকরা হয়তো রাস্তাকেই খোলা হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার কুফল তো কৃষকদেরই নিতে হচ্ছে। ফলে কৃষক-কৃষাণীদের এদিকে বিশেষ নজর নিজেদের স্বার্থেই দিতেই হবে। ছোটবড় শহরের বড় বড় রাস্তার পাশে বাস-ট্রাক সারিবদ্ধ করে রেখে সড়ককে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে। পথচারীদের চলতে হচ্ছে জীবনটা যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে। মোটরসাইসাইকেল? ওটা তো এখন মৃত্যুকল। দেশে চলাচলের উপযোগী না হলেও মাত্রাতিরিক্ত গতির মোটরসাইকেল দেদারছে আমদানির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এসব হাতে পেয়ে হেলে দুলে চালাতে গিয়ে বা মাত্রাতিরিক্ত গতির পর হুট করে থামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, ঝরছে প্রাণ। অতো গতির মোটরসাইকেল আমদানি কেন? আবদার মেটাতে আদরের দুলালদের হাতে যাচ্ছে এর অধিকাংশ। ফুটুনি! চালানো না শিখেই চালাতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। মাদকও দুর্ঘটনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। আর বড় বড় যানবাহগুলো? দেশে এখন দশ চাকার ট্রাক চলে। তার কুফল পড়ছে সড়কে। এছাড়া ৬ চাকার ট্রাকও আমদানির পর চেসিজ লম্বা করে অতিরিক্ত মালামাল বহনের উপযোগী করা হচ্ছে। এসব দেখার লোকবলও আছে। তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করছেন? সড়কে যে সব বাস চলে ওসবের ফিটনেস দেয়া হয় কীভাবে তা ভাবতেও কষ্ট হয়।
ঘরে বাইরে দুর্নীতি। দুর্নীতি অবশ্যই রাস্তার পাশের জমে থাকা ময়লার স্তুপ নয় যে ঝাড় দিলেই পরিষ্কার হবে। অস্বভাবিক আয়ের অসম্ভব রকমের প্রতিযোগিতা চলছে। এসব পথ রুদ্ধ করতে পারলে দুর্নীতির প্রতিযোগিতাটা কিছুটা হয়তো কমবে। মানসিকভাবে বদলানোর আহ্বান হাস্যকর বটে। বদলাতে বাধ্য করার মতো জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। বিধি-বিধান খাতা-কলমে থাকলে হবে না, তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনভঙ্গের প্রতি আইন প্রয়োগে দরদী হলে দরদ দেখানো কর্তার কর্তব্যহীনতার কুফল সমাজকেই বহন করতে হয়, হচ্ছে।