স্টাফ রিপোর্টার: পালাবদলের শেষ সময়ে এসে নানা ধরনের ছাড়ের (বিশেষ সুযোগ) হিড়িক পড়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার এর মাধ্যমে ভোটারদের কাছে টেনে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এ কৌশল নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় দম জোগালেও বেশকিছু ক্ষেত্রে তা বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বিশেষ শ্রেণি-পেশার ভোটার আকৃষ্ট করা সরকারের এ নির্বাচনী ছাড় প্রকল্প জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে, যার প্রভাব দেশের সর্বস্তরের মানুষের ওপর পড়বে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সচেতন ভোটারদের অনেকেই এ ফাঁদ থেকে দূরে থাকবেন।
তবে রাজনীতিকরা বলছেন, এ দেশের আমজনতা অতীত ইতিহাস বেশিদিন মনে রাখে না। দূর-ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার প্রবণতাও তাদের মাঝে নেই। তাই বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকার তাদের ক্ষমতার শেষ মেয়াদে যেসব ছাড় দিয়েছে, তাতে জাতীয় অর্থনীতিতে কী ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো, সাধারণ জনগণ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো, তা কেউ মনে রাখেনি। বরং প্রতিটি সরকারই তাদের শেষ সময়ের ছাড়ের জন্য নির্বাচনের মাঠে সাধারণ ভোটারদের আকণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। এমনকি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির টোপও জনগণ নির্বিঘ্নে গিলে ফেলেছে- এরও অসংখ্য নজির রয়েছে।
জানা গেছে, ভোটার ধরার জন্য গত তিন মাসে ক্ষমতাসীন সরকার প্রায় এক ডজন বড় মাপের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এছাড়াও আরো ডজন দুয়েক ছোট ও মাঝারি প্রকল্প জোরেশোরে চলছে। এরমধ্যে কৃষকদের খুশি রাখতে ইউরিয়া সারের ওপর চার টাকা ছাড়ের ঘোষণা গ্রামের ভোটারদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। যদিও এ সরকারই ২০১১ সালের ৩১ মে ইউরিয়ার দাম কেজিপ্রতি ১২ টাকা থেকে ৮ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা করেছিলো। তখন যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিলো- টিএসপি, এমওপি এবং ডিএপি (নন-ইউরিয়া) সারের সাথে ভারসাম্য আনতেই দাম বাড়ানো হযেছে। তবে এখন ভারসাম্য থিওরি থেকে সরে এসে বলা হচ্ছে- ফসলের উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে এবং টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে ইউরিয়া সারের মূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এসএম নাজমুল ইসলাম জানান, দাম কমানোর ফলে এখন সরকারকে কেজিপ্রতি প্রায় ১৮ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এ হিসাবে বছরে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা গচ্চা যাবে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সাড়ে চার বছরে সরকার যেসব প্রকল্প শুরু করতে পারেনি, শেষ সময়ে এসে সেগুলো তড়িঘড়ি করে ছাড় দেয়ার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাধিক বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সারাদেশে ১৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
দেশি-বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে ইনাম: নির্মাণের ব্যয় বাবদ ১৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে দ্রুত তা শুরু করা হচ্ছে। জানা গেছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের দেশের বন্যাকবলিত বিশাল এলাকার প্রায় ১ কোটি ভোটারকে কাছে টানার টার্গেট রয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীনদের দাবি, বন্যা উপদ্রুত এলাকার প্রাণহানি রোধ এবং অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষায় এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার মেয়াদের পুরোভাগ নিস্ক্রিয় থেকে শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে এ প্রকল্প শুরু করায় তাদের আসল উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে গেছে। ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মেয়াদের শেষ সময়ে বিদ্যুতের নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি (পিলার) কেনা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণে ব্যবহার করা হবে। যদিও এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ৬১ হাজার ৬৫০টি, জুলাইয়ে ১২ হাজার ৫০টি খুঁটি কেনা হলেও তা এখনো কাজে লাগানো হয়নি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও বিপুলসংখ্যক বিদ্যুতের খুঁটি কিনে সঞ্চালন লাইন না বসিয়ে তা শুধু মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। মূলত জনগণকে টোপ দিয়ে ভোট নেয়াই ছিলো ওই সময়কার সরকারের উদ্দেশ্য। সেই একই কায়দায় এবার আওয়ামী লীগ সরকারও মানুষকে ধোঁকা দেয়ার তালে রয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।
এদিকে, সারাদেশে ১০ হাজার নির্বাচনী নলকূপ বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। দলীয় এমপি এবং সরকারদলীয় স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের পছন্দের জায়গায় এসব নলকূপ বসানো হবে। এজন্য মেয়াদের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে তাদের কাছ থেকে এলাকার নাম সংগ্রহ করে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ তালিকা অনুযায়ীই কেন্দ্র থেকে নলকূপ বরাদ্দ দেয়া হবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটানো এ উদ্যোগ পুরোপুরি হিতে বিপরীত হবে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেছেন, সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত উপজেলা পরিষদ আইন ও বিদ্যমান বিধানের পরিপন্থী। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে উপজেলা ওয়াটসান কমিটি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ কমিটির সভায় নলকূপ কোথায় এবং কাকে দেয়া হবে, তা নির্ধারণ করার কথা। যদি কমিটিকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে কেন্দ্র থেকে তালিকা করে দেয়া হয়, তবে তা হবে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের প্রতি চরম অবজ্ঞা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সরকারের শেষ সময়ে নির্বাচনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোট বাগাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অক্টোবরে স্থায়ী পে-কমিশন গঠন এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মহার্ঘ্য ভাতা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এজন্য চলতি বাজেটে অপ্রত্যাশিত খাতে প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ রাখা আছে। গ্রামের নিম্নবিত্তের কর্মজীবী নারীদের ভোট পেতে ক্ষমতাসীন সরকার মেয়াদের শেষভাগে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের বিশাল প্রকল্প শুরু করেছে। ৯০ হাজার ৯৬০ কিলোমিটার সড়ক বছরব্যাপি রক্ষণাবেক্ষণে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ২ জুলাই অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। গ্রামীণ পর্যায়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের পরামর্শে বড় বরাদ্দের এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে গ্রামীণ নারীদের কাজের বিনিময়ে অর্থ কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের পল্লী কর্মসংস্থান ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি’র আওতায় এ প্রকল্পে গ্রামীণ বাজার ও সার্ভিস সেন্টার সংযোগকারী সড়কগুলো বছরব্যাপী রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। এতে মোট ৪ হাজার ৫৪৮টি ইউনিয়নে ৫৯ হাজার ১৮০ জন নারীর কর্মসংস্থান হবে। প্রকল্পে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮১৩ কোটি টাকা জোগান দেবে এবং প্রকল্প সাহায্য হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৮৯ কোটি টাকা দেবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আশা, তৃণমূলে যোগাযোগ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের এ প্রকল্পটি দলীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারে এগিয়ে রাখবে এবং এর সঙ্গে সংম্পৃক্ত ৬০ হাজার নারী ও তাদের পরিবার এ প্রকল্প থেকে উপকারভোগী হলে তা ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এদিকে, চলতি মেয়াদে না পারলেও আগামীতে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলে আরো বেশকিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হবে ঘোষণা দিয়ে সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরা ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ছাড়ের আগাম ঘোষণা’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ইন্টারনেট সংযোগের বিশাল মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট জয় তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন- আওয়ামী লীগ পুনর্নির্বাচিত হলে ২০০ টাকায় ১ এমবি সংযোগ দেবে। জয় দাবি করেন, গত ৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ইন্টারনেটের পাইকারি মূল্য ৮০ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার ৮০০ টাকায় হ্রাস করে। শতকরা হিসাবে এ হ্রাসের পরিমাণ ৯৪ শতাংশ। এতে ইন্টারনেটের খুচরা মূল্যও নেমে আসে। বর্তমানে দেড় হাজার টাকায় ১ এমবি সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এরপরও ইন্টারনেট সংযোগের মূল্য আরো কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে দাবি করে জয় তার স্ট্যাটাসে বলেন, ‘আমার লক্ষ্য হলো, ৫ এমবি সংযোগ ৪ হাজার টাকায় সহজলভ্য করা, যাতে ১ এমবি সংযোগ হবে ১ হাজার টাকার নিচে। আমাদের এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা ইতোমধ্যে রয়েছে এবং আওয়ামী লীগ যদি পুনর্নির্বাচিত হয়, তবে পরিকল্পনামতো অচিরেই এ নতুন মূল্য বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু আমি সেখানে থামব না, আমি পরিকল্পনা করেছি, আগামী ৫ বছরের মাঝে ৫০০০ টাকায় ২৫ এমবি সংযোগ দেব। ১০০০ টাকায় আপনি তখন ৫ এমবি সংযোগ পাবেন এবং ১ এমবি সংযোগের মূল্য দাড়াবে মাত্র ২০০ টাকা।
এদিকে, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু টোলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সেতুটি যেহেতু সিটির আওতায়, তাই আগামীতে এর ইজারা বাতিল করা হবে। এটি শুধু তার প্রতিশ্রুতিই নয়, আগামীতে সুযোগ পেলে তিনি অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করবেন বলে ইঙ্গিত দেন।
তবে শুধু জয় বা ওবায়দুল কাদেরই নন, সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপি এবং নেতারা ‘ছাড়ের আগাম ঘোষণা’র ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। বিশেষ করে মন্ত্রীরা চলতি মেয়াদে জনগণের যেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেননি, আগামীতে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন বলে ওয়াদা করছেন।