স্টাফ রিপোর্টার: সংবিধানের আলোকে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরেশোরে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে নির্বাচন করার জন্য অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ হবে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থায় নির্বাচন করার প্রস্তুতিও রাখা হচ্ছে।
জানা গেছে, সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এই হিসাবে ২৭ অক্টোবর থেকে সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হবে। এ জন্য ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। এর মধ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন চূড়ান্ত, ভোটকেন্দ্র চূড়ান্তকরণ, আচরণবিধি পরিবর্তন, সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়াল, নতুন ও পুরনো ভোটারদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ শেষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কমিশন। সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আইনি বিষয়গুলোর খসড়া সম্পন্ন হবে। অক্টোবরে সেগুলো যাচাই-বাছাই, আপত্তি ও পরামর্শ এবং সর্বশেষ তা নিষ্পত্তি করা হবে। আর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখা হবে। তবে তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকবে কমিশনের। যে পদ্ধতিতেই নির্বাচনের সমঝোতা হোক কমিশন সেভাবেই নির্বাচন আয়োজন করবে। আর নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে সমান সুযোগ সৃষ্টি করবে কমিশন। সূত্র জানায়, কমিশন ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা, কেন্দ্র তালিকা, উপকরণ সংগ্রহ করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এনেছে। অক্টোবরের মধ্যে দাতা সংস্থা থেকে অমোছনীয় কালি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সও চলে আসবে। নির্বাচনী সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজও এর মধ্যে সম্পন্ন হবে।
জানা গেছে, নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালাতে হাত দিয়েছে কমিশন। আইন ও বিধির আলোকে মনোনয়নপত্র, ব্যালট পেপারসহ বিভিন্ন ফরম এবং নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়ালের খসড়া করা হয়েছে। ইসি সচিবালয় থেকে প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করে তা সিইসির কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
চূড়ান্ত হচ্ছে ভোটকেন্দ্র আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সারাদেশের ভোটকেন্দ্রের তালিকা চূড়ান্ত করছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য কমিশন থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে কমিশন থেকে ২২টি নীতিমালাও করে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, রোববারের মধ্যে সারাদেশের সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ তালিকা ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। এসব ভোটকেন্দ্র সম্পর্কে কারো আপত্তি কিংবা কোনো সুপারিশ করার জন্য ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেয়া হবে। আপত্তি কিংবা সুপারিশ নিষ্পত্তি করার জন্য ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সুযোগ রাখা হয়েছে। এসব প্রক্রিয়া শেষ করে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করে তা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠানোর নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে নীতিমালার মধ্যে রয়েছে আগের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখা, আলোচনার ভিত্তিতে নতুন ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, রাজনীতি কিংবা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামের প্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন না করা, সরকারি ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, দুই হাজার পাঁচশ ভোটারের জন্য একটি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা, বিশেষ ক্ষেত্রে এর কম ভোটার নিয়ে কেন্দ্র স্থাপন করা। পরিচয়পত্র বিতরণ
প্রায় এক কোটি ভোটারকে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কাজও অক্টোবরের মধ্যে শেষ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। যেসব ভোটার তাদের পরিচয়পত্র পাননি তাদের মাঝে আগামী বুধবার পরিচয়পত্র বিতরণের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। কমিশন সূত্র জানায়, সারাদেশে ৯ কোটি ২১ লাখ ২৯ হাজার ৮৫২ জন ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছেন। এরমধ্যে নতুন তালিভুক্ত ৭০ লাখ ১৭ হাজার ৫২১ জন এ বছর হালনাগাদে যোগ হয়েছেন। যেসব কেন্দ্রে বা স্থানে ভোটার করা হয়েছে ঢাকার সেসব স্থানে নতুন ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হবে। তবে সারাদেশে জেলা পর্যায়ে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ডগুলো থেকে এসব পরিচয়পত্র বিতরণ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিগত হালনাগাদে প্রায় ২৫ লাখ পরিচয়পত্রও বিতরণ করা হবে। সব মিলিয়ে মোট এক কোটি ভোটার তাদের পরিচয়পত্র পাবেন।
এদিকে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসে সারাদেশের সর্বমোট ৯ কোটি ২১ লাখ ২৯ হাজার ৮৫২ জন ভোটারের তালিকা মুদ্রণের কাজ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে তালিকা ছাপার কাজ শেষ করার জন্য কমিশন থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নির্বাচনে ইসির প্রস্তুতি: জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আইন ও বিধিমালা সময়োপযোগী করা, ব্যালটবাক্স, কালি, সিলসহ নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় করা, মনোনয়ন ফরমসহ বিভিন্ন প্রকার ফরম ও প্যাকেট, নির্দেশিকা মুদ্রণ, নির্বাচনী ব্যয়ের বাজেট প্রণয়নের কাজ শেষ করতে হয়। তফসিল ঘোষণার পর ব্যালট মুদ্রণ, যাচাই-বাছাই ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। এ হিসাবে তফসিল-পূর্ব সময়ে নির্বাচনের মূল প্রস্তুতি নিতে হয়। সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। আসনভিত্তিক ভোটার সিডি তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের মালামাল একসঙ্গে সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোছনীয় কালি ও ব্যালটবাক্স সরবরাহ করবে ইউএনডিপি। নির্বাচনের জন্য ৪০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালটবাক্স, ৬ লাখ ৪৮ হাজার অমোছনীয় কালি (কলম আকারে) ও ২৪ লাখ ব্যালটবাক্স লক সরবরাহের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ৬ লাখ ৪৮ হাজার স্ট্যাম্প প্যাড, ৯০ হাজার ব্রাশ সিল, ৬ লাখ ৪৮ হাজার অফিসিয়াল সিল (ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার ব্যবহারের জন্য), ১১ লাখ ২৩ হাজার মার্কিং সিল (ভোট দেয়ার সিল) ও ১৭ হাজার ৩০০ কেজি সিলগালা (লাল রংয়ের) কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।
কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা: বিভিন্ন স্তরে ৭ লাখ ১৮ হাজার নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে ইসি। প্রয়োজনের তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ বেশি কর্মকর্তা নিয়োগের পরিকল্পনা তাদের। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তার পাশাপাশি সরকারের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে এসব কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। তাছাড়া ২ লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং এবং ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩৭ পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হবে। সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে এদের নিয়োগ দেয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ জানান, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনী প্রস্তুতির সব কার্যক্রম শেষ করা হবে। নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। কোন মাসে তফসিল এবং ভোটগ্রহণ করা হবে তা নির্ধারণ হয়নি। কমিশনের সভায় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সংসদ নির্বাচনের জন্য আনুষঙ্গিক উপকরণ সংগ্রহসহ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
নির্বাচনে সব প্রার্থীর বেলায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করার শতভাগ আশ্বাস দিয়েছেন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী। তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ। তিনি বলেন, সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে নির্বাচন করা কঠিন হবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আকস্মিক নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি কমিশনের থাকবে বলে সব কমিশনার একমত পোষণ করেছেন।