স্টাফ রিপোর্টার: আপিল বিভাগের রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনীত সরকারপক্ষের ষষ্ঠ অভিযোগ একাত্তরে মিরপুরের হযরত আলী, তার স্ত্রী, দু মেয়ে ও দুই বছরের ছেলেকে হত্যা এবং ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সাথে সংশ্লিষ্টতার ঘটনায় তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে গতকাল মঙ্গলবার এ রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার সাজা বাড়াতে সরকারপক্ষের করা আবেদন মঞ্জুর করে এ রায় দেয়া হয়েছে। রায়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত চার নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আপিল বিভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দিয়েছেন। অন্যদিকে সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে কাদের মোল্লার করা আপিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে খারিজ করা হয়েছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শাসুদ্দিন চৌধুরী। পাঁচ বিচারপতির মধ্যে একজন বিচারপতি কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের আদেশের সাথে একমত হতে পারেননি। তারপরও তার মৃত্যুদণ্ডই মূল রায় হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এ রায়টিই হলো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম কোনো চূড়ান্ত রায়।
এ মামলায় করা আপিলের শুনানি ১ এপ্রিল শুরু হয়। দীর্ঘ ৩৯ কার্যদিবস ধরে রাষ্ট্রপক্ষ, আসামি পক্ষ ও এ মামলায় নিযুক্ত সাত অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য গ্রহণ শেষে ২৩ জুলাই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
আপিল বিভাগের রায়: সকাল সাড়ে ন’টার দিকে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ কাদের মোল্লার মামলায় সরকারপক্ষ ও আসামিপক্ষের করা আপিলের ওপর সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করেন। তিন মিনিটের প্রদত্ত এ রায়ে বলা হয়, এ মামলায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারপক্ষের করা আপিল (২৪/২০১৩) গ্রহণযোগ্য (মেইনটেইনেবল) বলে বিবেচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে আপিল মঞ্জুর করা হলো। চার নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বাতিল করা হলো এবং আসামি এই অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হয়েছে। এই অভিযোগের জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো। ছয় নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের (৪:১) ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। খালাস চেয়ে আবদুল কাদের মোল্লার করা আপিল (২৫/২০১৩) ঐকমত্যের ভিত্তিতে খারিজ করা হলো। এছাড়া এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন ও পাঁচ নম্বর অভিযোগে দেয়া সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের (৪:১) মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়েছে।
কাদের মোল্লার মামলার ঘটনাপ্রবাহ: মিরপুরের কসাই খ্যাত আবদুল কাদের মোল্লা একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরও একটি মামলা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। এ দুটি মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অভিযোগের তদন্ত ও অনুসন্ধান শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। ২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে আনীত ছয় অভিযোগ: পল্লব হত্যার সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগটি ছিল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ। তার নির্দেশে আকতার গুণ্ডা একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পাওয়া গেছে, একাত্তরে নবাবপুর থেকে পল্লবকে ধরে আনার মতো দুষ্কর্মে আসামির সহযোগিতা ছিলো। পল্লব মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। এ জন্য তিনি আসামির শিকারে পরিণত হন। এ হত্যাকাণ্ড ছিলো দেশের বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ। এ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের সাজা দেয়া হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ (কবি মেহেরুননিসা ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা): এ অভিযোগ অনুসারে একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দু ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন হত্যাকারী। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়, সহযোগীদের নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে কাদের মোল্লা এ হত্যাকাণ্ডে নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, যা দুষ্কর্মে সহযোগিতার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে তাকে ১৫ বছরের সাজা দেয়া হয়।
তৃতীয় অভিযোগ (সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা): একাত্তরের ২৯ মার্চ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুরের জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা জবাই করে হত্যা করেন। প্রাপ্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, খন্দকার আবু তালেব হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা মূল অপরাধীদের নৈতিক সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, যা মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতার মধ্যে পড়ে। এ অভিযোগেও তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
চতুর্থ অভিযোগ (ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড): একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর (শহীদনগর) এলাকায় শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দুজন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী আবদুল মজিদ পালোয়ান ও অষ্টম সাক্ষী নূরজাহান বেগম যে আসামিকে চিনতেন, তা প্রাপ্ত সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল বিশ্বাস করতে পারেননি। ফলে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় না যে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাকিস্তানি সহযোগীদের সাথে রাইফেল হাতে কাদের মোল্লা নিজে উপস্থিত ছিলেন। হত্যাকাণ্ড যে ঘটেছিলো, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের সাাথে আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে খালাস দিলেও আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।
পঞ্চম অভিযোগ (আলুব্দীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ): একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামের পশ্চিম দিকে নামে। কাদের মোল্লা অর্ধশত অবাঙালি, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিয়ে গ্রামের পূর্ব দিক থেকে ঢোকেন এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। ওই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যান। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে, হত্যাকাণ্ডের সময় কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে স্বশরীরে উপস্থিত দেখা গেছে। কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ যখন অনেক ব্যক্তি ঘটায়, তখন ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকে ওই অপরাধ এককভাবে সংঘটনের জন্য সমানভাবে দায়ী। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ (হযরত আলী, তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণ): একাত্তরের ২৬ মার্চ মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনের হযরত আলী, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই বছরের ছেলেকে হত্যা এবং তার ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সঙ্গে কাদের মোল্লা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হযরতের আরেক মেয়ে ওই ঘটনা লুকিয়ে থেকে দেখেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন হযরতের পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য লুকিয়ে থাকা ওই মেয়ে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধের ঘটনাস্থলে কাদের মোল্লার উপস্থিতি অপরাধের সাথে তার সংযুক্তিতা প্রমাণ করে। আইনগতভাবে ধরে নেয়া যায়, অপরাধ সংঘটনে আসামি নৈতিক সমর্থন ও সাহায্য করেছেন। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। মঙ্গলবার আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন ও আইন সংশোধন: পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও ৫ ফেব্রুয়ারি দেয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। তার ফাঁসির দাবি ওঠে। ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু যে আইনে বিচার হচ্ছে সেই আইন অনুযায়ী একবার সাজা হলে তার বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের আপিলের কোনো সুযোগ ছিল না। এর ফলে কাদের মোল্লার সাজা বাড়াতে আইনী বাধা ছিলো। এ অবস্থায় জনরোষের মুখে সরকার ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিল সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করে আইন পাস করে। সংশোধনীতে সাজা বাড়ানোর জন্য সরকারপক্ষের আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দেয়া সাজাকে অপর্যাপ্ত দাবি করে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়ে তিন মার্চ আপিল করে সরকারপক্ষ। এরপর চার মার্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা।
আপিল শুনানি ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি আইনগত প্রশ্ন: কাদের মোল্লার মামলায় করা আপিলের ওপর শুনানি ১ এপ্রিল শুরু হয়। দীর্ঘ ৩৯ কার্যদিবস দুপক্ষের আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন আপিল বিভাগ। আপিল শুনানিকালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনী প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তা হলো- দণ্ড ঘোষণার পর আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল (প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন) প্রযোজ্য হবে কি-না। আসামিপক্ষ দাবি করেন, আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালের আইনের যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ কাদের মোল্লার বিচার আইন সংশোধনের আগেই শেষ হয়েছে। এছাড়া কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল এ বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন।
এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আইনগত পরামর্শ দানের জন্য ২০ জুন সুপ্রিমকোর্টের সাতজন বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবীকে এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। তাদের মধ্যে এ সংশোধনী আবদুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মতামত দিয়েছেন ৫ জন। তারা হচ্ছেন- ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। অন্য দুই এমিকাস কিউরি সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ মনে করেন, এটি প্রযোজ্য হবে না। তাদের মতে, কাদের মোল্লার বিচার শেষ হওয়ার পরে এ সংশোধনী আনা হয়েছে। এছাড়া ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি মনে করেন, সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে আপিল বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে, যেকোনো মামলার সাজা বাড়ানো বা কমানোর। এতে কেউ আপিল না করলেও কাউকে অপরাধ অনুযায়ী কম সাজা দেয়া হয়েছে, নাকি বেশি সাজা দেয়া হয়েছে- সুপ্রিমকোর্ট তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে খতিয়ে দেখতে পারেন।
অন্যদিকে কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল (প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন)-এর আওতায় এ মামলা পড়বে বলে তিনজন, পড়বে না বলে দুজন এবং অন্য দুজন ভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের মতে, এই ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও এএফ হাসান আরিফের মতে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। আর ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির মতে, প্রযোজ্য হবে যদি তা দেশীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দেশীয় আইনের সোথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এটি প্রযোজ্য হবে না। টিএইচ খানের মতেও প্রযোজ্য হবে। তবে তিনি মনে করেন, যে ক্ষেত্রে দেশীয় আইনের সোথে আন্তর্জাতিক আইনকে সাংঘর্ষিক বলে মনে হবে, সে ক্ষেত্রে দেশীয় আইন প্রাধান্য পাবে।
সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ শুরু: বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচার করা। আর সেই লক্ষ্যে এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যুদ্ধাপরাধ বিচারে ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে সাতজনের বিচার শেষ করেছেন। রায় ঘোষণা করেছেন ছয়টি মামলার। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি দেয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর এ রায়ের পর দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ। সেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি সহিংস রূপ নেয়। ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৫ জুলাই জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের জেল এবং ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। আর বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর মামলার বিচার শেষ হলেও এখনও রায় ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষিত ৬টি রায়ের মধ্যে ৫টির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়েছে। পলাতক থাকায় আবুল কালাম আজাদ এখনও আপিল করেননি। দায়েরকৃত পাঁচটি আপিলের মধ্যে সর্বপ্রথম শুনানি শেষে রায় দেয়া হলো কাদের মোল্লার। অন্য কোনো আপিলের ওপর এখনও শুনানি শুরু করা সম্ভব হয়নি।