বিএনপির রূপরেখায় নির্দলীয় ব্যক্তিই সরকার প্রধান

 

স্টাফ রিপোর্টার: আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের বিধান সংবলিত রূপরেখা তৈরি করছে বিএনপি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রস্তাবিত ওই রূপরেখায় আলোচনার মাধ্যমে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় একজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধান নির্বাহী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করার কথা বলা হতে পারে। এক্ষেত্রে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির (বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) ব্যাপারে তীব্র আপত্তি থাকলেও তার আগের প্রধান বিচারপতি কিংবা তারও আগের প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে দলটির আপত্তি থাকবে না।

সূত্রমতে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনা হলে ওই প্রস্তাব বিএনপি সেখানে নিয়ে যেতে চায়। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। তবে জাতিসংঘের মহাসচিবের অনুরোধ অনুযায়ী সরকারি দল জাতিসংঘে না গেলে বিএনপিও সেখানে যাবে না। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্রমতে, সংলাপ ও সমঝোতার জন্য জাতিসংঘের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকায় বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতেই ওই সফর বাতিলের কথা ভাবা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বিএনপির দাবি সংবলিত প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারপতির মধ্য থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান করার বিষয়ে জোর দেয়া হবে। এছাড়া প্রবীণ ও গ্রহণযোগ্য কোনো আইনজীবীর ব্যাপারেও দলটির আপত্তি নেই। তবে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা কিংবা সুশীল সমাজের মধ্য থেকে সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে বের করা কঠিন বলে তারা মনে করেন।

সূত্র জানায়, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই বিএনপির বেশ কয়েকজন আইনজীবী নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীর একটি দল ওই রূপরেখা প্রণয়নে কাজ করছে। তবে শেষ পর্যন্ত তা জনগণের সামনে তুলে ধরা হবে কি-না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। যদিও সোমবার এক সেমিনারে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শিগগিরই রূপরেখা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এ প্রশ্নে মতভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশস্থ কূটনৈতিক মহল ও সুশীল সমাজের একটি অংশ এ ধরনের একটি রূপরেখা দেয়ার জন্য বিএনপিকে উৎসাহ দিচ্ছে। পাশাপাশি দলের একটি অংশেরও এতে সায় আছে। কিন্তু বিএনপির অপর একটি অংশ কোনো ধরনের রূপরেখা দেয়ার বিরোধী। তাদের মতে, রূপরেখা যতো ভালোই হোক বিএনপি দিলে তা আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করবে। একইভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও বিএনপি তাতে রাজি হবে না। ফলে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কারও মধ্যস্থতা বা আড়ালেই সমঝোতা হওয়াই ভালো বলে তারা মনে করে।

সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য নোটিশ দিয়েও বিএনপি তা প্রত্যাহার করে নেয়। বলা হয়, জমা দেয়া ওই নোটিশটি ছিলো সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনের। এছাড়া সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী একজন নেতা এ ধরনের একটি রূপরেখা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে দলে সমালোচিত হন। পরে একাধিক নেতা বক্তৃতা-বিবৃতিতে জানান, সংসদে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা বাতিল করে দিতে পারে। তাই সংসদে প্রস্তাব উত্থাপনে তারা আগ্রহী নন। তবে এবারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হলে সংসদে অথবা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রূপরেখা দেয়া হতে পারে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির রূপরেখা দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হুবহু চাই। কিন্তু এর বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে আপত্তি থাকলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে অবশ্যই একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে হবে। সুতরাং ওই ব্যক্তি কে হবেন তা আলোচনা করে বের করা যায়।

মির্জা ফখরুলের ঘোষণার পর খবর নিয়ে দলীয় রূপরেখা তৈরির উদ্যোগের কথা নতুন করে জানা যায়। সূত্রমতে, প্রস্তাবে বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়কের আদলেই নতুন করে কিছু ব্যবস্থার কথা বলা হবে। উচ্চ আদালতের রায়ে বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রথম বিকল্প হিসেবে আলোচনার মাধ্যমে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে বেছে নেয়ার প্রস্তাব দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও দু দলের পাঁচজন করে সদস্য সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে বিএনপির ভেতরে আপত্তি কম। তবে কৌশলগত কারণে এ বিষয়টি তারা প্রস্তাবে উত্থাপন নাও করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় আরও যেসব বিকল্প রয়েছে তাও খতিয়ে দেখছে বিএনপি। তবে দলীয় বা রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিকে দলটি গ্রহণ করবে না।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করিবেন। তবে শর্ত ছিলো যে, উক্তরূপ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহলে রাষ্ট্রপতি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে যে প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণ করেছেন তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। ৪ উপধারায় বলা হয়, যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় তাহলে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তাও না পাওয়া গেলে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে না পাওয়া যায় তাহলে রাষ্ট্রপতি যতদূর সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেবেন। আর এসব বিধানাবলী কার্যকর না করা গেলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রপতি তার নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে বিধান রাখা হয়।

বিএনপি ককাসের রূপরেখা: এদিকে গতকাল সোমবার সকালে বিরোধীদলীয় সংসদীয় ককাসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা সুপারিশ করেন বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ওই প্রস্তাব বিএনপির নয়।
ককাসের প্রস্তাবে বলা হয়, নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন একজন প্রধান উপদেষ্টা। তার সরকারের সদস্য সংখ্যা হবে ১৫ জন, মেয়াদ হবে তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিন।

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক পছন্দ অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি (আপিল বিভাগ) ও সংসদের স্পিকারের মধ্যে থেকে অথবা ঐকমত্যের ভিত্তিতে পেশাজীবী, সুশীল সমাজের কোনো প্রতিনিধি বা বিশিষ্ট কোনো নাগরিক বা শিক্ষাবিদকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করা যেতে পারে।

১৫ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা আসবেন বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, সরকারি চাকরিজীবী, প্রথিতযশা আইনজীবী, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে।

৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও বিধি প্রণয়ন এবং সরকারের দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নেবে এই অন্তর্বর্তী সরকার। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলে সেমিনারে দুটি সুপারিশমালাও উপস্থাপন করেন বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক।