শিশু আতাউর অপহরণের নেপথ্যে বাহিনী প্রধান দুখু!

দুখু বাহিনীর অজানা তথ্য ফাঁস : মুক্তিপণের আশায় এক গ্রাম থেকে সাতজন অপহর

 

মেহেরপুর অফিস: মেহেরপুর সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম শুভরাজপুর থেকে অপহৃত স্কুলছাত্র আতাউর এখনও উদ্ধার হয়নি। তবে অপহরণকারীরা ৫ লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে বলে তার প্রবাসী পিতার কাছে ফোন করেছে বলে জানা গেছে। গত ৪ দিনেও শিশুটির সন্ধান না পাওয়ায় তার ভাগ্যে কি জুটেছে তা নিয়ে চিন্তিত শিশুটির মা ছামেনা বেগমসহ পরিবারের সদস্যরা। এদিকে এলাকার অপহরণ ও মুক্তিপণ নিয়ে ফেরত দেয়ার সব ঘটনার এটিও দুখু বাহিনীর কাজ বলে এলাকার অনেকে দাবি করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে এলাকায় ৭ জনকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে দুখু বাহিনী তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে।

শিশুপুত্র আতাউর অপহরণের ঘটনা নিয়ে এ গ্রামে মোট সাতজনকে দুখু বাহিনী অপহরণ করে ভারতে নিয়ে যায়। এরা হলো শুভরাজপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে রায়হান (৪০), আব্দুস সাত্তারের ছেলে সুজন (৩৪), ওয়াজেদ আলীর ছেলে পঞ্জাতুল্লাহ (৫৫), মওলা বক্সের ছেলে আব্দুল মতিন (৫৭), আসাদের ছেলে সাবদার আলি (৬০) ও সফিউল মাস্টারের ছেলে জাহান আলী (৪০)। এরা বিভিন্ন সময়ে অপহরণ হলেও যোগাযোগের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপন দিয়ে দুখু বাহিনীর নিকট থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। শিশু আতাউলের অপহরের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

ccccc copy

শিশুপুত্র আতাউরকে অপহরণের সময় অপহরণকারীরা তার মা ছামেনার ব্যবহৃত একটি মোবাইলফোন লুট করে নিয়ে যায়। ওই মোবাইল থেকে অপহরণকারীরা অপহৃত আতাউরের পিতা দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী আলিফকে ফোন করে। তারা তাকে বলেছে, চিঠি দিয়ে কাছে ২ লাখ টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। তোর ছেলে এখন আমাদের হাতে। ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে তোর ছেলেকে ফেরত দেবো না বরং জবাই করে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। এ সংবাদে পিতা আলিফ ভেঙে পড়েছেন। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কিন্ত আতাউর কোথায় আছে, তাকে কেমনভাবে রাখা হয়েছে? তার ভাগ্যে কি ঘটেছে অপহরণকারীরা তা জানায়নি। কোথায় টাকা পৌঁছে দিতে হবে তাও তারা জানায়নি। অপহরণকারীরা শিশু আতাউরকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই রাতে একই উপজেলার শোলমারী-শুভরাজপুরের মাঝামাঝি স্থানে ভারতের নদীয়া জেলার রাউদবাড়ি মাঠে সীমান্তের তার কাটা কেটে ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করে। কাথুলি বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার নায়েক সুবেদার আব্দুল খালেক জানান, গত বুধবার বিকেল ৩টার দিকে ১৩৩/৩ এস মেন পিলারের কাছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ’র সাথে বিজিবি পতাকা বৈঠক করে। বৈঠকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবি সদস্যদের জানান, একটি ডাকাতদল তার কাটা কেটে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলো। এ সময় বিএসএফ তাদের দিকে তাক করে গুলি ছোঁড়ে। সম্ভবত একজন ডাকাত গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তারা আরো জানান, অপহরণ শেষে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এলে তারা শিশুটিকে উদ্ধারে চেষ্টা করবে বলে আশ্বাস দেয়।

এদিকে আব্দুস সামাদের বাড়ি থেকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ কাথুলী পযর্ন্ত দেখা যাওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের ধারণা বিএসএফ’র গুলিতে অথবা ডাকাতদলের বোমা বিস্ফোরণে তাদের নিজেদের কেউ আহত হতে পারে। তাই যে পথ দিয়ে গেছে সে পথে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে। একটি সূত্র জানায়, পার্শ্ববর্তী ধলা গ্রামের গুলিবিদ্ধ এক ডাকাত সদস্যকে এ ঘটনার পর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে চুয়াডাঙ্গা শহরের কোনো এক ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে। সেখান থেকে সে আত্মগোপন করেছে। খোঁজ নিলে অপহরণের রহস্য উদঘাটনের সহায়ক হতে পারে বলে এলাকার অনেকে ধারণা করছেন।

এলাকার অনেকে কুখ্যাত দুখু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পায়। তবে পুলিশ ও এলাকার লোকজন সবাই জানে অপহরণ ঘটনা যতগুলো ঘটেছে, তার সবগুলোতে দুখু বাহিনী জড়িত থাকে। দুখু বাহিনীর প্রধান দুখুর বাড়ি মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বিলধলা গ্রামে। তার পিতার নাম আতিয়ার। পেশায় তিনি ছিলেন পুলিশ। দুখুর নামে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজী, ডাকাতিসহ অসংখ্য মামলা থাকায় বর্তমানে সে ভারতের মর্শিদাবাদ জেলার টেহট্রো থানার বর্শিবাড়িয়া গ্রামে জমি কিনে বসবাস করছে। সে দেশের ভোটার হয়েছে ও নাগরিকতা পেয়েছে দুখু। দুখু বিয়ে করেছে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার ধাড়া গ্রামে। তার শ্বশুরের নাম সোয়েব আলী। পেশায় তিনি একজন ঘোড়ার গাড়িচালক।

বর্তমানে মেহেরপুর সদর ও গাংনী থানায় দুখুর নামে প্রায় ৩০টি মামলা রয়েছে। একটি খুনের মামলায় ফাঁসি, ৩টি খুন মামলায় যাবজ্জীবন ও একটি অপহরণ মামলাতে তার ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। বাকি মামলাগুলি চলমান আছে। মামলাগুলো তার মা বুলবুলি খাতুন পরিচালনা করেন। প্রশাসনের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য তার মা বুলবুলি একবার আদলতের মাধ্যমে দুখুকে তেজ্য পুত্র করেন। ওদিকে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকুল থানা, নদীয়া জেলার করিমপুর থানা ও তেহট্রো থানায় দুখু বাহিনী প্রধান দুখুর নামে বর্তমানে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজী ও ডাকাতিসহ মোট ৩২টি মামলা চলমান আছে। এসব মামলা পরিচালনা করেন দুখুর স্ত্রী ও তার শ্বশুর।  দুখু বাহিনীর ক্যাডাররা মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিশু ও বড় মানুষ অপহরণ করে ভারতে তার কাছে পৌঁছে দেয়। তারপর মোবাইলে মুক্তিপনের টাকার চুক্তি করে। মুক্তিপণ বুঝে নিয়ে অপহৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয় তারা। তার ক্যাডারবাহিনী বিভিন্ন সময়ে মেহেরপুর সদর ও গাংনী উপজেলার উত্তরঅঞ্চলের ধলা, কাথুলি, কালীগাংনী, গাড়াডোব, সহগোলপুর, নওপাড়া, কুতুবপুর, শুভরাজপুর, শোলমার, কুলবাড়ি, উজ্জ্বলপুর, ঝাউবাড়িয়া, শ্যামপুর, ভাটপাড়া, তেতুলবাঁড়ি, খাসমহল ও করমদি গ্রাম থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ জনকে অপহরণ করে ভারতের নিয়ে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অপহরণচক্র ও ডাকাতদল অপহৃত ব্যক্তিকে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার রাখালগাছি, রংপুর, গোগাইপুর, টেপিদহ, বাঁশবাড়িয়া, পিপুলবাড়িসহ মর্শিদাবাদের কিছু অংশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্থান পরিবর্তন করে আটক রাখে। ভারতের বিভিন্ন থানার পুলিশ আদায় করা মুক্তিপণের টাকার একটি অংশ পেয়ে দুখু বাহিনীর অপরাধমূলক কাজে সাহায্য করে বলে সূত্রটি আরো জানিয়েছে। দুখু বাহিনীর প্রধান দুখু খুন ও অবৈধ অস্ত্র রাখার মামলায় ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কারাগারে তিন বছর হাজত বাস করে গত এক মাস আগে ছাড়া পেয়ে আবার পুরোদমে খুন, ডাকাতি ও অপহরণ শুরু করে দিয়েছে। ভয়ঙ্কর দুখু বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ধলায় একটি পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। কয়েক বছর আগে দুখু বাহিনীর ক্যাডাররা ওই ধলা পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের সাথে বন্ধুক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তখন এক এসআই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তার পরেও দুখু ও তার ক্যাডারদের ধরা সম্ভব হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের ভোটকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ধরে দুখুবাহিনী প্রধান দুখুসহ তার ক্যাডারা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে বিলধলা গ্রামের ইউপি সদস্য ইমদাদুল হক, বিএনপি নেতা জাহিদুল ও ব্যবসায়ী রুহুল আমিন নামের আপন ৩ ভাইকে গুলি ও কুপিয়ে খুন করে জেলায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এমনকি অপরাধ কাজে তার দলের কোনো ক্যাডার ভুল করলে তাকে গুলি করে মারতে দ্বিধা করে না দুখু। তার হাতে তার নিজের দলের কুখ্যাত ক্যাডার ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার কলাবাড়ি গ্রামের দেলুয়ার, মেহেরপুরের খোকশা গ্রামের বজলু, কুতুবপুর গ্রামের বুদু, নওপাড়ার সিপু, কাজিপুরের মিল্টন, শ্যামপুরের তাহিরসহ ২০/২৫ জন খুন হয়েছে।

দুখু বাহিনীর প্রধান দুখুর টার্গেট অপহরণের নামে ব্যবসা। ওই অপহরণে কেউ বাধা দিলে তাকে খুন করে লাশ ফেলে যায়। অপহৃতকে বাঁচিয়ে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা। তারই শিকার হয়ে খুন হয়েছেন মেহেরপুর শুভরাজপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক আব্দুল হালিম। এখন এলাকাবাসী তাকিয়ে আছে অপহৃত শিশু আতাউরকে উদ্ধারে পুলিশ ভূমিকা কি হবে?

আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও। তোমরা যা চাও তাই দেবো। আমার বুকের মানিককে ছেড়ে দাও। অপহৃত ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র আতাউরের মা ছামেনা খাতুন বুকফাঁটা আর্তনাদ করছে। আবার মাঝে মাঝে বিলাপ বকতে বকতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।

উল্লেখ্য, মেহেরপুর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম শুভরাজপুরে গত বুধবার রাতে অপহরণকারীদের গুলি ও বোমা হামলায় স্কুল শিক্ষক আব্দুল হালিম নিহত হন। তার বড় ভাই আব্দুস সামাদের নাতি ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র শিশু আতাউরকে (১০) অপহরণকারীরা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায়। অপহৃত আতাউরের পিতা আলিফ দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী। এ ঘটনায় নিহতের সেজো ভাই আব্দুল মান্নান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১০/১৫ জনকে আসামি করে হত্যা, অপহরণ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে ৩টি মামলা দায়ের করেছেন। এ ব্যাপারে মেহেরপুর সদর থানার ওসি রিয়াজুল ইসলাম জানান, অপহরণচক্রের সদস্যদের গ্রেফতার ও অপহৃত শিশুকে উদ্ধারে জোর তৎপরতা চলছে।