দেশে মাদকের বিস্তার কতোটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সে চিত্র উঠে এসেছে গত শুক্রবার কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘মাদকের জন্য বছরে পাচার ১০ হাজার কোটি টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এ বিপুল পরিমাণ টাকায় কেনা হচ্ছে কিশোর-তরুণদের জন্য মৃত্যু উপকরণ। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের সম্ভাবনাময় একটি অংশকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে মাদক ব্যবসা। টাকার অঙ্কে বছরে যাকে শনাক্ত করা হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকায়, দেশ ও জাতির ক্ষতির হিসাবে তাকে কোন অঙ্কে চিহ্নিত করা যাবে?
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬৮ লাখ। এদের ৮৪ শতাংশ পুরুষ এবং ১৬ শতাংশ নারী। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ মানুষ মাদকব্যবসার সাথে জড়িত। মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য এ মাদকাসক্তরা নানাবিধ অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। তারা খুন-ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ ও দেহব্যবসায়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। সোজা কথায়, ১০ হাজার কোটি টাকার মাদক অর্থনীতি দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে ক্ষতি করছে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর। মাঝেমধ্যে ঐশীর মতো ব্যতিক্রমী ঘটনা আমাদের আলোড়িত করে টনক নড়িয়ে দিচ্ছে বটে। কিন্তু সেটা যেন বুদ্বুদ বলে প্রতিভাত হয়। মাদকব্যবসা ও মাদকের শিকড় এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বিস্তৃত যে তা প্রায় দূরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সমাজে নিত্যনতুন নেশাদ্রব্যের আবির্ভাব ঘটছে। ইয়াবা, সিসা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, মদ, কোকেন ইত্যাদি একটির সাথে আরেকটি পাল্লা দিয়ে বিস্তার লাভ করছে। গত কয়েক মাস ধরে পুলিশ ও র্যাব মাদকব্যবসার ওপর ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, প্রতিবছর মাদকের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। এ টাকার বেশির ভাগই যাচ্ছে ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানি মাদকব্যবসায়ীদের পকেটে। মাদকব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এসব অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে বলে তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। সন্দেহ নেই, মাদক মাফিয়ারা রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। মাত্র কয়েক দিন আগে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার এক রাজনৈতিক নেতা মাদক-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করায় মাদকব্যবসায়ীরা তাকে হত্যা করেছে। এর কয়েক দিনের ব্যবধানেই এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা রামপুরায় নিজগৃহে খুন হয়েছেন এলাকার মাদকব্যবসায়ীদের হাতেই। উভয়ের খুনিরাই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করছে। এ দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে, মাদক মাফিয়ারা কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ পাচ্ছে। অর্থাৎ ভূত তাড়ানোর সর্ষেতেই ভূতের আছর হয়েছে।
বলা হয়, স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, সংক্রামক হচ্ছে ব্যাধি। মাদকের সংক্রমণ, মাদকের ব্যধি ধীরে ধীরে আমাদের জাতিকে ভেতর থেকে নিঃশেষ করে ফেলার আগেই যদি আমরা একে প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে বর্তমান প্রজন্ম এবং দেশের ভবিষ্যত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। মাদক প্রতিরোধের দায়িত্ব কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকলেই হবে না, সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মাদকের কুফল সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে। জাতিকে রক্ষা করতে হবে মাদকের করাল গ্রাস থেকে।