স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি উদ্যোগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ১৪ লাখ বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র আড়াই শ গেছেন। এর মধ্যে দুজন পালিয়ে যাওয়ায় এখন পুরো প্রক্রিয়ায়ই (জি টু জি- দু দেশের সরকারি পর্যায়ে) হুমকিতে পড়েছে। কাজে যোগ দেয়ার পর তারা সহকর্মীদের না জানিয়ে পালিয়ে গেছেন দালালদের প্ররোচনায় বেশি বেতনের লোভে। মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তার কাছে জমা রাখা বাংলাদেশি পাসপোর্টেরও পরোয়া করেননি ওই দুজন। মূলত তাদেরই কারণে শুরু হয়েছে অবৈধ অভিভাবসিদের ধরপাকড়। সেখানে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় দেশে তাদের স্বজনদের কাটছে অনিশ্চয়তার প্রহর।
জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়ে এমনিতেই ত্যক্ত-বিরক্ত। সরকারি উদ্যোগেও সুষ্ঠুভাবে জনশক্তি রপ্তানি না করা গেলে মালয়েশিয়া স্থায়ীভাবে বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দিতে পারে। মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সাড়ে চার বছর বন্ধ থাকার পর গত এপ্রিলে মালয়েশিয়া জনশক্তি নেওয়া শুরু করে। বেসরকারি পর্যায়ে নানা অনিয়মের পর এবার সরকারিভাবে জনশক্তি যাচ্ছে। এজন্য সারাদেশের ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। নাম নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১৪ লাখ। তাদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিতদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার একেএম আতিকুর রহমান গত শুক্রবার বলেন, সরকারি পর্যায়ে যাদের আনা হয়েছিলো, তাদের মধ্যে দুজন পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র চাকরি নিয়েছেন। এটা অপ্রত্যাশিত। জাতি হিসেবে আমাদের কিছু কমিটমেন্ট আছে। এখানে ১৪ লাখ বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় এ ঘটনা বিরাট ধাক্কা দেবে। এর পরও আশা করি মালয়েশিয়া সরকারকে বোঝাতে পারবো। কারণ ৫ শতাংশ সিস্টেম লস হতেই পারে। যারা পালিয়েছেন তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশে অপারগতা জানিয়ে হাইকমিশনার বলেন, তাদের ধরা পড়তে হবে। কারণ এ বাজার চালু করতে সরকারকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। দিনের পর দিন মালয়েশিয়া সরকারের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে। এটা অনেক কষ্টের ফসল। এদিকে মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী গ্রেফতার অভিযান জোরদার হওয়ায় ঘোর হতাশা নেমে এসেছে বাংলাদেশের লাখো পরিবারে। ইতোমধ্যে ৩৮৭ জন বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়েছেন। অবৈধ অভিবাসীদের কাজে যোগ দিতেও নিষেধ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ফলে কষ্টের টাকায় দেশটিতে পাঠানো স্বজনের খেয়ে-পরে টিকে থাকা, গ্রেফতার হওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে দুই লাখের বেশি পরিবারের।
জানা গেছে, অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় বড় ধরনের অভিযানে গত রোববার থেকে ২৪ ঘণ্টায় দু হাজার ৪৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। গতকাল সোমবার সকালে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদি সংবাদ সম্মেলনে জানান, রাজধানী কুয়ালালামপুর ও আশপাশের কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোট আট হাজার ১০৫ জনকে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনী। এর মধ্যে বৈধ কাগজ থাকায় পাঁচ হাজার ৬৭২ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বাকি দু হাজার ৪৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, আটককৃতদের মধ্যে ৩৮৭ জন বাংলাদেশি, ইন্দোনেশিয়ার ৭১৭ জন, মিয়ানমারের নাগরিক ৫৫৫ জন এবং নেপালের রয়েছেন ২২৯ জন। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, চীন, নাইজেরিয়া ও থাইল্যান্ডের নাগরিকও রয়েছেন। অভিবাসনবিষয়ক কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল ডিফেন্স, ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের ১৫০ কর্মকর্তাসহ দুই হাজার ২০৭ সদস্যের বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী আজ (সোমবার) সকাল পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করে।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বৈধ হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের কথামতো বাংলাদেশ দূতাবাসে নিবন্ধন কিংবা পাসপোর্ট নবায়ন করেননি। মোশাররফ হোসেন আরো বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফরের সময় সে দেশের সরকারকে অনুরোধ করেছি, আমাদের কোনো লোক আটক হলে পাসপোর্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখানোর জন্য তাদের যেন ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। আটকদের যেন কোনো সাজা না দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, আশা করছি, আমাদের শ্রমিকদের কোনো সাজা হবে না এবং আমরা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবো।
এদিকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, যারা কাগজপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন, সেসব কর্মীকে যে কারখানা কিংবা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে সেসব প্রতিষ্ঠান-কারখানার মালিককেও শাস্তি এবং জরিমানা করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। এতে মালয়েশিয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা অবৈধ বিদেশি কর্মীদের কাজে আসতে নিষেধ করছেন।
জানা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কারখানায় অবৈধ কর্মী পাওয়া গেলে মালিককে ৫০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা গুনতে হবে কিংবা পাঁচ বছরের জেল হবে। অথবা ছয়টি বেত্রাঘাত খেতে হবে। একসাথে তিনটি শাস্তিও হতে পারে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী নির্দিষ্ট এলাকা ব্লক করে দিয়ে অভিযান চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, যার আওতায় বাংলাদেশ থেকে এখন কেবল সরকারিভাবেই লোক পাঠানো হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার থেকে যাদের আটক করা হচ্ছে, তাদের বৈধতা প্রমাণের কাগজপত্র দেয়ার জন্য ১৪ দিনের সময় দেয়া হবে। তা না পারলে তাদের জায়গা হবে ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মতে, মালয়েশিয়ায় পাঁচ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত, যাদের একটি বড় অংশ বৈধতার জন্য ওই দেশের সরকারের দেওয়া সুযোগ এরই মধ্যে কাজে লাগিয়েছে।