স্টাফ রিপোর্টার: নয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চালাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এদের মধ্যে কেউ অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে, আবার কেউ অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস খুলে বসেছে। এ জন্য পুলিশি অভিযান চালিয়ে ওইসব ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে পুলিশি অ্যাকশন চালানোর আগে ওই নয়টির মধ্যে যে কটি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, একটি আদালতে এনে তাদের সবকটি মামলা আগে নিষ্পত্তি করা হবে। এরপরই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলি বলেন, গত ২২ আগস্ট চিহ্নিত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী হাতে পাওয়ার পর তারা নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানের সুপারিশ করে পত্র দেবেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ ব্যাপারে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, যে নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পত্র দেয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিটি, পিপলস ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি।
অধ্যাপক শিবলি আরও জানান, এগুলোর মধ্যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি তাদের মতিঝিলের অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করেছে বলে পত্র দিয়ে জানিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সরেজমিন দেখতে হবে। আর এগুলোর বাইরে দশম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম ছিলো। কিন্তু তারা তাদের ঢাকা আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নয়টি ইউনিভার্সিটির মধ্যে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটিসহ যেগুলোর সরকারের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং স্থগিতাদেশ নিয়ে চলছে, সেসব মামলা একটি আদালতে এনে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হবে। মামলা নিষ্পত্তির পরই চালানো হবে কঠোর অভিযান। সরকার তথা ইউজিসির বিরুদ্ধে মামলার ব্যাপারে ওই প্রতিষ্ঠানের প্যানেল আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেলকে সহায়তা করবে। মামলার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়ার পর সব মামলা একটি আদালতে নিয়ে এসে শুনানির ব্যবস্থা করা হবে।
মামলার রয়েছে এমন তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়। একটি হচ্ছে বোর্ড অব ট্রাস্টিজে দ্বন্দ্ব এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া মালিকানারও দাবিদার রয়েছে। আরেকটি রয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। এ ক্যাটাগরিতে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকায় একটি আউটার ক্যাম্পাস রয়েছে (যদিও তারা মামলা প্রত্যাহারের ওয়াদা দিয়েছে মন্ত্রণালয়কে)। বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম শহরে একাধিক আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। নর্দান ইউনিভার্সিটি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে রাজশাহী ও খুলনায় ২টি আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। এর বাইরে তাদের ঢাকায় মিরপুর রোড ও ফার্মগেট এলাকায় দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ঢাকার বাইরে রাজশাহী ও খুলনায় আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। তবে এসব ক্যাম্পাস বন্ধ করেছে বলে তারা গত ২৮ জুলাই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। তৃতীয় ধরনের মামলা হচ্ছে মালিকানার দাবি নিয়ে পরস্পরে বিবদমান গ্র“পগুলোর দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি যেগুলোর পক্ষ হয়েছে।
আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় মামলার জোরে বা স্থগিতাদেশ নিয়ে চলছে না, সেগুলোর অবৈধ ও আউটার ক্যাম্পাস বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে পত্র দেয়া হবে। অর্থাৎ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। এ তালিকায় ইবাইস ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তারা শিক্ষার স্বার্থে আরও এক ধরনের উদ্যোগ নেবেন। সেটি হচ্ছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজে (মালিকানায়) দ্বন্দ্ব আছে কিন্তু মামলা নেই, মূল ঠিকানার বাইরে কার্যক্রম চালাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পত্র দেয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে ইউজিসি মধ্যস্থতা করে দ্বন্দ্ব নিরসনের মতো একটি উদ্যোগও নেবে বলে জানা গেছে। এ ক্যাটাগরিতে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
নয়টি ইউনিভার্সিটির মধ্যে ৫টিতে মালিকানা দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে দেখা যায়। ওইগুলো হচ্ছে, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইবাইস ইউনিভার্সিটি ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি।
পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়: এদিকে বেশ কয়েকটি ইউনিভার্সিটি ‘পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত হয়েছে। জানা গেছে, সরকার ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও অ্যাকশনে যাওয়ার কথা ভাবছে। নাম প্রকাশ না করে মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির একাধিক সূত্র জানায়, ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোনোটির চেয়ারম্যান ছেলে আর ভিসি বাবা, আবার কোনোটির চেয়ারম্যান স্ত্রী, ভিসি স্বামী, ছেলে রেজিস্ট্রার। কোনোটি রয়েছে যেগুলোর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক পদে স্বামী, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ প্রমুখ রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী। তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও রেজিস্ট্রারের কাজ করেন। স্ত্রী এর আগে ট্রেজারার ছিলেন কিন্তু বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তারা ভিআইপি রোডের ৫০ গজের মধ্যে নিজেদের ক্যাম্পাস রেখেছে। কয়েক বছর আগে তাদের ক্যাম্পাসটি যখন একেবারে ভিআইপি রোডের পাশে ছিল, তখন ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে যখন-তখন গাড়ি ভাংচুর করে। ওই ঘটনার পর তাদের ক্যাম্পাস ভিআইপি রোড থেকে সরানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তারা এমন জায়গায় ক্যাম্পাস স্থানান্তর করেছে, যেটা আইনত ভিআইপি রোডের এরিয়ার মধ্যেই পড়ে। আরও অভিযোগ, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া হয় না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট আদায় করা হয় না। পরীক্ষা হয় ঢিলেঢালা পরিবেশে। ফলে শিক্ষার্থীরা নামেমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করছে সেখানে।