সিআইডির সাবেক এডিশনাল এসপিকে গুলি করে খুন

স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক এডিশনাল এসপি ফজলুল করিমকে (৬৭) সন্ত্রাসীরা গুলি করে খুন করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অজ্ঞাত তিন সন্ত্রাসী পশ্চিম রামপুরা ৭৫/২ ওয়াপদা রোডে তার বাসায় ঢুকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনায় ফজলুল হকের ড্রাইভার লিটনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। তবে কি কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সে ব্যাপারে পুলিশ কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। তবে নিহতের মেয়ে ফারজানা করিমের দাবি, চাচাতো ভাইদের সাথে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। নিহত ফজলুল করিম বছর পাঁচেক আগে চাকরি থেকে অবসর নেন বলে জানা গেছে। অবসরের আগে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশসূত্রে জানা গেছে, রামপুরার ওয়াপদা রোডের ৭৫/২ নম্বর বাড়ির মালিক ফজলুল করিম। ৫ তলা এই বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে তিনি সস্ত্রীক বসবাস করতেন। গতকাল সকালে তিনি বাসার বারান্দায় (ঘর সদৃশ) বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তখন ৩ জন অস্ত্রধারী বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় ফজলুল করিমের স্ত্রী আফরোজা খান স্বপ্না ওই দুর্বৃত্তদের কাছে জানতে চান কেন তারা এ বাসায় এসেছেন। এসময় তিন দুর্বৃত্তর মধ্যে একজন পিস্তলের মুখে স্বপ্নাকে অন্য একঘরে নিয়ে যায়। একই সময় অপর এক অস্ত্রধারী বাসার কাজের ছেলে আজাদ (৯) এবং কাজের মেয়ে সুমীকে রান্না ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। এরপর অন্য অস্ত্রধারী বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে ফজলুল করিমের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। তিনটি গুলি করে খুন নিশ্চিত হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। পরে বাড়ির লোকজন ফজলুল করিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার খবর পেয়ে রামপুরা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৩ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করে। ড্রাইভার, গৃহকর্মী ও আশপাশের লোকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

নিহত ফজলুল করিমের স্ত্রী আফরোজা খান স্বপ্না জানান, তিনি রান্না ঘরের কাজ করছিলেন। ফজলুল করিম বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। তাদের ড্রাইভার লিটন ডাইনিং টেবিলে বসে নাশতা করছিলো। লিটন নাশতা শেষে বের হয়ে যায়। তিনি তখন দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। এ সময় ২০/২২ বছরের হালকা-পাতলা গড়নের কালো একটি ছেলে ভেতরে প্রবেশ করে এবং স্বপ্নার গলায় পিস্তল ঠেকিয়ে গলা থেকে স্বর্ণের চেন ছিনিয়ে নেয় এবং একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। তখন বাসায় আরো দু যুবক ভেতরে প্রবেশ করে। তারা কাজের ছেলে আজাদ ও কাজের মেয়ে সুমীকে রান্না ঘরের পাশের বারান্দায় নিয়ে আটকে রাখে। এ সময় তার চিত্কার শুনে ফজলুল করিম বারান্দা থেকে ড্রয়িংরুমে গিয়ে ওই তিন যুবককে দেখতে পান। এ সময় ফজলুল করিমের সঙ্গে যুবকদের উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে শুনতে পান স্বপ্না। তখন স্বপ্না তার মেয়েকে ফোন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘটনার আকস্মিতায় ঘাবড়ে গিয়ে মেয়ের মোবাইল ফোন নম্বর মনে করতে পারছিলেন না। তখনই তিনি ৩টি গুলির শব্দ শুনতে পান।

ফজলুল করিমের বাসার কাজের ছেলে ৯ বছরের আজাদ ও ১২ বছরের কাজের মেয়ে সুমী জানায়, অস্ত্রধারী তিনজন লোক তাদেরকে বারান্দায় নিয়ে আটকে রাখে। এরপর তারা গুলির শব্দ শুনেছে। কিন্তু যারা এসেছিল তাদেরকে আগে কখনো তারা দেখেনি। আজাদ জানায়, সন্ত্রাসীদের মধ্যে একজন ফজলুল করিমের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটি গুলি করে। এরপর ফজলুল করিম সোফার ওপর পরে গেলে তাকে আরো দুটি গুলি করে। এরপর তারা বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়।

2ne3

নিহত ফজলুল করিমের প্রাইভেট কারের চালক লিটন জানান, তিনি নাশতা শেষে বাড়ির নিচে এসে গাড়ি পরিষ্কার করছিলেন। তখন তিনি প্রথমে এক যুবককে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে দেখেন। এরপরে আরো দু জন ওপরে ওঠে। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। গুলির শব্দ শুনে তিনি ওপরে উঠতে থাকেন। তখন সিঁড়িতে ওই ৩ জনকে দ্রুত নেমে যেতে দেখেন। তাদের হাতে অস্ত্র থাকায় তিনি কিছু বলতে সাহস পাননি। ওপরে উঠে দেখেন সন্ত্রাসীরা ফজলুল করিমকে গুলি করে চলে গেছে। পরে বাসার লোকজন এবং ভাড়াটিয়াদের সহযোগিতায় ফজলুল করিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে ফজলুল করিমের মেয়ে ফারজানা করিম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালমর্গে জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার রামকৃষ্ণদিতে ফজলুল করিমের গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে পৈতৃক জমিজমার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ফজলুল করিমের সাথে তার চাচাতো ভাইদের কিছুদিন ধরে বিরোধ চলছিলো। গত বুধবার তিনি এই বিরোধ মীমাংসা করতে সিরাজদিখান যান। সারাদিন দেনদরবার শেষে রাতে ঢাকায় ফিরে আসেন। বুধবার রাতে ঢাকার বাসায় আবার তাদের বৈঠকে বসার কথা ছিলো। ফারজানা দাবি করেন চাচাতো ভাইরাই তার বাবাকে খুন করেছে। তাদের গ্রেফতার করলেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসবে।

ফজলুল করিমের জামাতা ফারজানার স্বামী চৌধুরী মুকিম উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর জানান, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে গুলশানে বসবাস করেন। সকালে এ ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে যান। কি নিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে তা তিনি জানেন না।

এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে ডিবি, সিআইডি, ৱ্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসাসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ দেখে মনে হচ্ছে, খুনিরা ফজলুল করিমের পূর্ব পরিচিত। কোনো বিরোধের জের ধরে তারা ঘরে প্রবেশ করে কোনো কিছু দাবি করছিলো। এই নিয়েই ফজলুল করিমের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা ফজলুল করিমের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়। শুধুমাত্র হত্যার মোটিভ নিয়ে ভেতরে ঢুকলে কোনো কথা না বলেই তারা গুলি করে পালিয়ে যেতো। যদি তারা ডাকাতির উদ্দেশ্যে আসতো তবে কোনো রুমে আটকে রেখে মালামাল নিয়ে পালিয়ে যেতো। সিআইডি’র এডিশনাল এসপি আরমান আলী ঢাকা মেডিকেলের মর্গে জানান, ৬/৭ বছর আগে তিনি অবসরে যান। ওই সময় তার হাতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মামলার তদন্ত কাজও ছিলো না। কর্মক্ষেত্রেও কারো সাথে তার কোনো শত্রুতা ছিলো না। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কি কারণে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

নিহত ফজলুল করিমের চাচাতো ভাই আব্দুল হাই খান জানান, চাকরি জীবনের শেষ দিকেই তিনি পুরোদমে নামাজ-কালাম পড়া শুরু করেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে শুরু করেন। পরিবারের কারো সাথে তার কোনো বিরোধ ছিলো না। তিনি গ্রামের বাড়িতে শেখ মো. মিয়ারউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া স্থানীয় কুমনি মাদরাসার সভাপতিও ছিলেন। তিনি রামপুরার তাকওয়া মাদরাসা ও এতিমখানার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

নিহত ফজলুল করিম ১৯৬৯ সালে সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর হিসাবে পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন। চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। আশির দশকে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত ও আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করেন। বিশেষ করে কালিগঞ্জের কুখ্যাত ডাকাত মুকিমগাজী এবং সিরাজদিখান, লৌহজং, মাওয়া, মেঘনা নদী এলাকার কুখ্যাত অনেক ডাকাত দলকে কঠোরভাবে দমন করেন। মূলতঃ ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল তিনি অবসরে যান। এক বছর এলপিআরে থাকার পর তত্কালীন সরকার তাকে আরো এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ২০০৬ সালে তিনি পুরোপুরি অবসরে চলে যান। অবসরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সিআইডি’র এডিশনাল এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

আশির দশকের শেষ দিকে নিহত ফজলুল করিম এসিডিবি ছিলেন। তখন রাজধানীর মতিঝিল সোনালী ব্যাংক ওয়াপদা শাখা ও এলিফ্যান্ট রোডে শীতল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ডাকাতির ঘটনা ছিলো আলোচিত। মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে ডাকাত দল সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করে ভল্ট থেকে সমুদয় টাকা নিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে। সে সময় ক্লু লেস এ দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের এসি হিসেবে কর্মরত ফজলুল করিম খানের ওপর। ফজলুল করিম দুটি ডাকাতির রহস্যই উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেফতার করেছিলেন।

হত্যাকাণ্ড নিয়ে সিরাজদিখানে নানা গুঞ্জন: ঢাকার রামপুরায় ওয়াপদা রোডে নিজ বাসভবনে সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম হত্যাকাণ্ডে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে শোকের ছাড়া নেমে আসে। এলাকায় অত্যন্ত সাধুজন হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তির খুনের সংবাদ শুনে অনেকেই সাথে সাথে চলে গেছেন তার ঢাকার বাসায়। এই পুলিশ কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এলাকাবাসীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত। আবসরের পর সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে কেউ বলছেন পুলিশে কর্মরত থাকা অবস্থায় ফজলুল করিম অনেক দুর্ধর্ষ অপরাধের সাথে জড়িত থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করায় তাদেরই কেউ এ কাজ ঘটিয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ বলছেন, সম্প্রতি ফজলুল করিম একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের সম্পর্কে একটি সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে অনেক স্পষ্ট ও কড়া ভাষায় কথা বলেছিলেন, এ কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের লোকজন তাকে হত্যা করতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, কন্যা ঐশীর হাতে নিহত পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ফজলুল করিমের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি সেখানে গিয়ে ঐশীর বন্ধুদের ধমকা-ধমকি করেন। এ কারণেও তিনি খুন হয়ে থাকতে পারেন। কেউ কেউ বলেছেন, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের কারণে তিনি খুন হয়ে থাকতে পারেন।

সিরাজদিখানে নিজ বাড়িতে দাফন সম্পন্ন: গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফজলুল করিম খানকে তার নিজ বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার রামকৃষনদী গ্রামে দাফন করা হয়েছে। রাত ৮টায় এলাকায় জানাজা শেষে তার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া মোহাম্মদিয়া কওমি মাদরাসার পাশে দাফন করা হয়েছে। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।